৪১৬ বছরের প্রাচীন আঙুরলতা গিনেস রেকর্ডে স্থান পেল

স্বাধীন আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

তিব্বতের পূর্বাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার গ্রাম ঝোবায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিস্ময়কর আঙুর গাছ, যা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জীবিত বুনো আঙুরলতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। চার শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রকৃতির ঝড়-তুফান, তীব্র শীত ও খরার মতো কঠিন পরিবেশ সহ্য করেও আজও টিকে আছে এই গাছটি।

পাহাড়ি মালভূমির শক্ত ও অনুর্বর মাটিতে গাছটির শিকড় গভীরভাবে গেঁথে আছে। শিকড় যেন পাহাড়ের বুকে আঁকড়ে থাকা ইতিহাসের প্রতীক, আর ডালপালা সময়ের বলয়ে জড়িয়ে আছে অনন্ত জীবনের ছোঁয়ায়। স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই এই গাছটিকে ‘পবিত্র লতা’ বলে সম্মান দিয়ে আসছেন।

চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়—এই আঙুরলতাটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো জীবিত বুনো লতা। গবেষণা অনুযায়ী, এর বর্তমান বয়স ৪১৬ বছর। প্রায় আট মিটার উঁচু গাছটির গোড়ার পরিধি ২০৯ সেন্টিমিটার, আর কাণ্ডের ব্যাস ৬৭ সেন্টিমিটার

গাছটির সন্ধান প্রথম মেলে চাংদু শহরের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক বৃক্ষের তৃতীয় পর্যায়ের জরিপে। এরপর চীনের সাউথওয়েস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটির উড সায়েন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা বিস্তারিত গবেষণা চালান। তারা রিং অ্যানালাইসিস (গাছের কাণ্ডের বৃত্ত বিশ্লেষণ) ও শারীরিক পরিমাপের মাধ্যমে গাছটির বয়স নির্ধারণ করেন।

এর আগে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো আঙুরলতা হিসেবে পরিচিত ছিল স্লোভেনিয়ার মারিবরে অবস্থিত বিখ্যাত দ্য ওল্ড ভাইন। ১৯৭২ সালের এক গবেষণায় এর বয়স ৩৫০ থেকে ৪০০ বছরের মধ্যে বলে অনুমান করা হয়। তবে সময়ের ক্ষয়ে গাছটির কেন্দ্রীয় অংশ পচে যাওয়ায় সঠিক বয়স নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে তিব্বতের এই নতুন আবিষ্কার পুরনো রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

চীনা কৃষি বিজ্ঞান একাডেমির ফলগাছ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক ড. ওয়াং হাইবো বলেন, “দুই হাজার চারশ মিটার উচ্চতায় চার শতাব্দীরও বেশি পুরনো এক বুনো আঙুরলতা পাওয়া প্রকৃতির ধৈর্য ও জীবনের স্থিতিস্থাপকতার এক অনন্য নিদর্শন। এটি শুধু একটি রেকর্ড নয়, এটি সময়ের জীবন্ত দলিল।”

সাধারণত চাষ করা আঙুরগাছ খুব কমই ৫০ বছর টিকে থাকে, আর শতবর্ষী গাছ পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ঝোগাং কাউন্টিতেই এখনো একশ বছরের বেশি বয়সী অন্তত ৬৪টি আঙুরলতা টিকে আছে। স্থানীয় জলবায়ু, উচ্চতা ও মাটির বিশেষ উপাদানই সম্ভবত গাছগুলোর দীর্ঘায়ুর রহস্য বহন করছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

এই অঞ্চলের মদ প্রস্তুতির ঐতিহ্যও প্রাচীন। ইতিহাসবিদদের মতে, ঝোগাংয়ের মদ তৈরির ঐতিহ্য অন্তত এক হাজার বছর পুরনো। এমনকি তিব্বতের বিখ্যাত সাহিত্য দ্য এপিক অব কিং গেসার-এও এই অঞ্চলের আঙুর ও মদের উল্লেখ রয়েছে। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ২০০৪ সালে ঝোগাংকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘চায়নার বুনো লাল আঙুরের জন্মভূমি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

গিনেস রেকর্ডের স্বীকৃতি পাওয়ার পর এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক আঙুরলতাটিকে সংরক্ষণে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। গাছের চারপাশে প্রতিরক্ষামূলক বেড়া, পর্যটন পথ এবং তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ চলছে, যাতে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীরা নিরাপদে এই জীবন্ত বিস্ময়টি উপভোগ করতে পারেন।

বিজ্ঞানীদের মতে, আঙুরলতার প্রতিটি বৃত্ত বা রিং শুধু গাছের বয়সের হিসাবই ধরে রাখে না, বরং ওই সময়ের জলবায়ুগত পরিবর্তনের ইতিহাসও বলে দেয়। কোন বছরে তাপমাত্রা বেশি ছিল, কোন সময়ে বৃষ্টি বা খরা—সবই রিংয়ের পুরুত্বে লুকিয়ে থাকে। তাই এই আঙুরলতা শুধু একটি গাছ নয়, এটি যেন চার শতাব্দীর জলবায়ু পরিবর্তনের এক প্রাকৃতিক রেকর্ড।

আর হয়তো, এই কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়ি উপত্যকার কোথাও, মাটির গভীরে এখনো ঘুমিয়ে আছে আরও কোনো প্রাচীন আঙুরলতা—যা একদিন জেগে উঠবে, পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ করবে নতুন অধ্যায়, সময়ের আরও এক জীবন্ত সাক্ষ্য হয়ে।

সূত্র: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস / সাউথওয়েস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *