আব্দুর রহমান, কক্সবাজার:
স্বৈরচারী আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ছত্রছায়ায় থাকা পেঁচারদ্বীপ এলাকায় মারমেইডের স্বত্বাধিকারী সেই সোহাগ থামবে কবে? এমনটাই প্রশ্ন সচেতন মহলের। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ইসিএ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণের বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও সরকারি খাস জমি দখল করে রাতারাতি কটেজ নির্মাণ করে অনায়াসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন সোহাগ, নেই কোনো প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ। কোনোভাবেই থামছেন না কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার পেঁচারদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা মৃত নবিউল হকের পুত্র আনিসুল হক সোহাগ; জেলার অন্যতম শীর্ষ ভূমিদস্যু তিনি। যদিও তাঁর নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান/রাঙ্গুনিয়ায়, তবু তিনি পেঁচারদ্বীপের ভূমিদস্যু হিসেবে ইতিমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মারমেইড যেন জমির তিমি। যতই দখল করুক, পেট ভরে না মারমেইডের।
সেই সোহাগ তাঁর ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলাধীন মেরিন ড্রাইভ রোডের পেঁচারদ্বীপ ইসিএ এলাকায় অবৈধ একাধিক রিসোর্ট নির্মাণ করেছেন। একাধিক মামলার আসামি হয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি একর পর একর দখলে নিচ্ছেন সরকারি জায়গা।
১৯৯৮ সালের পূর্বে কুমিল্লা জেলার অধিবাসী ভূমিদস্যু আনিসুল হক সোহাগ (৪৭) কক্সবাজারে বেড়াতে এসে পেঁচারদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন নামে এক ব্যক্তির সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তাকে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর ০২ একর সরকারি খাস বন্দোবস্তকৃত জায়গা ৭ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়ে সেখানে মারমেইড ইকো রিসোর্ট তৈরি করেন। একসময় কবির হোসেনকে তিনি পেঁচারদ্বীপ এলাকা থেকে উচ্ছেদ করে দেন বলে অভিযোগ আছে। বর্তমানে কবির হোসেন উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং এলাকায় সরকারি বন বিভাগের জায়গায় বসবাস করছেন বলে জানা যায়। এভাবে আনিসুল হক সোহাগের ভূমিদস্যুতা শুরু হয়।
মেরিন ড্রাইভ রোডে অবস্থিত মারমেইড ইকো রিসোর্ট প্রতিষ্ঠার নামে স্থানীয় কবির আহমেদের সরকারি খাস বন্দোবস্তকৃত ০২ একর জমি দখলের মাধ্যমে আনিসুল হক সোহাগ ভূমিদস্যুতা শুরু করেন। একই এলাকায় মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে অবস্থিত মারমেইড ইকো রিসোর্ট ও মারমেইড বিচ রিসোর্টের নামে ভূমিদস্যু আনিসুল হক সোহাগ সেখানে সমুদ্র সৈকতের ইসিএ এলাকা, সৈকতসহ ৬০ একর সরকারি খাস জমি ও ১০ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি এ পর্যন্ত দখল করেছেন বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে স্থানীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হলে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসন থেকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। তবে অভিযান পরিচালিত হলেও পুনরায় তিনি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রাখাসহ সকল জায়গা বর্তমানে নিজের দখলে রেখেছেন।
প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে অবৈধ দখলবাজ ও ভূমিদস্যুদের তৈরি করা কটেজ টিকে থাকে টাকার জোরে। তাঁদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে রামু ভূমি অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। কাজেই তাঁদের এসব অপকর্ম নীরবে সহ্য করছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় একের পর এক সৈকতের বালিয়াড়ি দখল ও খাস জমি দখল করে চলছে কটেজ নির্মাণ।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফ বদরমোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। আইন অনুযায়ী, ইসিএ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু পেঁচারদ্বীপ এলাকায় কোনো অনুমতি না নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট। সেখানে রয়েছে আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থাপনা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পেঁচারদ্বীপ এলাকায় সড়কের পশ্চিম পাশে নামতেই মারমেইড বিচ রিসোর্ট। উত্তর-পশ্চিম পাশে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় নদী ও সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক স্থাপনা। কেউ যাতে বুঝতে না পারে, সে জন্য ঢালাইয়ের ওপর এক ফুট বালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পাশেই নির্মাণ করা হচ্ছে রেস্তোরাঁ। পশ্চিমের ঝাউবন-সমৃদ্ধ সৈকতটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ জায়গায় যাতায়াতের জন্য পাহাড় থেকে নেমে আসা রেজু খালের ওপর রয়েছে কাঠের সেতু। অবৈধভাবে ঝাউগাছ কেটে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশবাদী সংগঠনের তথ্যমতে, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পেঁচারদ্বীপ এলাকাটি লাল কাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র এবং কচ্ছপের ডিম পাড়ার আবাসস্থল। কিন্তু পর্যটকের যাতায়াত ও মারমেইড কর্তৃপক্ষের রাতে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উচ্চ আওয়াজ ও লাইটিংয়ের কারণে কচ্ছপ এখন আর সেখানে যায় না। হারিয়ে গেছে লাল কাঁকড়াও।
এলাকাবাসী জানান, মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালায় ভূমি অফিস। একটা-দুটো স্থাপনায় আঘাত করে চলে যায় প্রশাসন। এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্রতীরবর্তী ইসিএ এলাকার এক টুকরো খাস জমিও সরকারের হাতে থাকবে না বলে মনে করেন স্থানীয়রা। সরকারি খাস জমিগুলো দখলবাজদের হাতে চলে যাবে এবং তা দখলমুক্ত করতে সরকার ব্যর্থ হবে বলেও মন্তব্য সচেতন মহলের।
আনিসুল হক সোহাগের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টা, চাঁদাবাজি, হুমকি, জোরপূর্বক দখল, ভূমিদস্যুতাসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জেরে একাধিক মামলা রয়েছে। যার মধ্যে সিএমপির কোতোয়ালি থানায়, এফআইআর নং-৩১, তারিখ-৩০ আগস্ট ২০২৪, জিআর নং-৩৫৫, তারিখ-৩০ আগস্ট ২০২৪, ধারা: ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৩/৩২৪/৩০৭/৩২৫/৩২৬/১০৯/১১৪/৩৪ পেনাল কোড-১৮৬০; কক্সবাজারের রামু থানার এফআইআর নং-৭, তারিখ-০৬ মে ২০১৩, জিআর নং-১২৮, তারিখ-০৬ মে ২০১৩, ধারা: ৩৮৫/৪৪৭/৫০৬ পেনাল কোড-১৮৬০; সিএমপির কোতোয়ালি থানার এফআইআর নং-২১, তারিখ-১৩ অক্টোবর ২০২৪, জিআর নং-৪৩১, তারিখ-১৩ অক্টোবর ২০২৪, ধারা: ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৩/৩২৪/৩২৬/৩০৭/১০৯/৩৪ পেনাল কোড-১৮৬০ মামলাসমূহ উল্লেখযোগ্য। তিনি এসব মামলার এজাহারে অভিযুক্ত আসামি।
মারমেইড রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক সোহাগ আওয়ামী সরকারের সময় স্থানীয় আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সাথে সখ্যতা ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাঁর ভূমিদস্যু কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সাবেক এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা সায়মুম সরোয়ার কমলের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। তাছাড়া তিনি আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপি-নেতাদের সাথে সখ্যতা রেখে মারমেইডে বিভিন্ন অনৈতিক কাজও চালিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এই সূত্র ধরে বিগত সরকারের সময় উক্ত এলাকায় তিনি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ও ভূমি দখল কার্যক্রম করেন। যদিও তাঁর ৭টি খতিয়ানে দুই মৌজায় ২১ একর জমি আছে। এর বাইরে তিনি বিভিন্ন জন থেকে জোর করে নোটারি করে নিয়েছেন আরও প্রায় ২ একর। কিন্তু তিনি বর্তমানে সরকারি খাস জমি, ইসিএ এলাকার বালিয়াড়ি, অসহায় মানুষের জমি জবরদখল করে ৯০ একর জমি দখল করে বেশ কয়েকটি রিসোর্ট বানিয়ে আছেন। এখনো দখলের প্রক্রিয়ায় আরও বালিয়াড়ি ও সরকারি জমি দখলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানান এলাকাবাসী। এ যেন ভূমিদস্যুতা থামার পাত্র নন।
বর্তমানে তিনি স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের সাথেও সখ্যতা করার চেষ্টা করছেন বলে জানান এলাকাবাসীরা। এছাড়া সাবেক রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম তাঁকে উক্ত এলাকায় জমি দখলের কাজে সহযোগিতা করেছেন বলে স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে তিনি তাঁর প্রভাব খাটিয়ে ভূমিদস্যু কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে সরকারি খাস জমি দখল ও ইসিএ এলাকায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হলে শক্তহস্তে দমন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি গত সফরে কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেন। তিনি আরও বলেন, ইসিএ এলাকা ও বনভূমি দখলমুক্ত করা হবে এবং ইসিএ এলাকায় যার স্থাপনা হোক না কেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এরপরও কিভাবে তাঁরা কটেজ নির্মাণ করেন—এমন প্রশ্ন স্থানীয় সচেতন মহলের। পরিবেশ উপদেষ্টার কথার সাথে সাংঘর্ষিক হলেও রামু উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কটেজ নির্মাণ কাজে কোনো প্রকার বাধা দেওয়া হয়নি বলে জানান স্থানীয় জনসাধারণ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর কক্সবাজার জেলা সভাপতি সাংবাদিক এইচ.এম. এরশাদ বলেন, পেঁচারদ্বীপ এলাকায় মারমেইডের মালিক আনিসুল হক সোহাগ আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ছত্রছায়ায় দখলবাজি শুরু করেন। এখন তিনি শুধু ইসিএ এলাকা বা বালিয়াড়ি নয়, সমুদ্র পর্যন্ত নিজের সম্পত্তি মনে করেন। এখন তিনি সমুদ্র পর্যন্ত চলে গেছেন। এমন ভূমিদস্যু দেশে আর আছে কিনা সন্দেহ। তিনি রেজু খালের প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেজুখালকে মৃত খাল বানিয়ে ফেলেছেন প্রায়। রেজুখালভিত্তিক জেলেরা এখন কর্মহারা হতে চলেছেন। তাঁর এ শক্তি কোথা থেকে পায়? আমি পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করবো, আনিসুল হক সোহাগের জমির কাগজপত্র দেখে তাঁর বৈধ ও অবৈধ দখলকৃত সব জমি উদ্ধার করা হোক। নইলে আমরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করতে প্রস্তুত আছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর কক্সবাজার জেলা সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ কলিম বলেন, প্রশাসন মারমেইডের প্রতি এত দয়ালু কোন স্বার্থে? তাঁর ওপরে কি এতই শক্তিশালী? আমরা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোসহ সচেতন মহল ভূমিদস্যু আনিসুল হক সোহাগের লাগাম টানার জন্য পরিবেশ উপদেষ্টার প্রতি আবেদন জানিয়েছি।
এ বিষয়ে রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) স্বরূপ মুহুরী বলেন, আমি এ বিষয়ে এখনো জানি না। নতুন এসেছি মাত্র। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, আমি এসেছি ২ সপ্তাহ হচ্ছে। এত বড় বিষয়টি আমার জানা নেই। এখন জানলাম। আপনি (প্রতিবেদক) একটু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। আমি দ্রুত ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অফিসের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জমির উদ্দিন-এর ০১৮১৯৬৪৯৬৫৪ নম্বরে বার বার ফোন করেও কল রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ নিজাম উদ্দিন বলেন, আমি এর আগে অভিযোগ পেয়ে এসিল্যান্ড রামুকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি আমাকে রিপোর্ট দিয়ে যেসব অতিরিক্ত স্থাপনা করা হয়েছিল, সেগুলো তিনি ভেঙে দিয়েছেন। এখন যদি নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ করে থাকে বা আপনাদের হাতে তথ্য থাকে, দেন—আমি দ্রুত ব্যবস্থা নেব।