শহীদ জিয়া হল : ইতিহাস, ষড়যন্ত্র আর আনিসুল ইসলাম সানির সংগ্রাম

মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী, ব্যুরো চিফ: 

‘শহীদ জিয়া হল’ — একটি সংগ্রামের নাম, একটি ঐতিহ্যের নাম। অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে এই নামটার উপর দিয়ে। তবে শহীদ জিয়ার আদর্শকে বুকে ধারণ করেন এমন কয়েকজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখনো মাথা উঁচু করে সটান দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা।

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় ৬০.৬২ শতাংশ জমির উপর গড়ে ওঠা শহীদ জিয়া হলটি ছিল একসময় সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলার কেন্দ্রস্থল। নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সরব থাকত জিয়া হল। নাগরিক ভাবনার উন্মেষ ঘটত এই প্রাঙ্গণে। অথচ কালের সাক্ষী সেই শহীদ জিয়া হলটি আজ জরাজীর্ণ ভগ্নস্মৃতির স্তূপ।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এটি যেন কোনো একটি পরিত্যক্ত ভবন। সামান্য বৃষ্টি হলেই ছাদের ফাটল ও টিনের চালা দিয়ে ঝরঝরিয়ে পানি পড়ে। দেয়ালে ছত্রাকের ছোপ, দরজা-জানালার ভগ্নাংশ। আর এই অবস্থায় সেখানে আস্তানা গেড়েছে মাদকসেবী আর ছিনতাইকারীরা। পাশাপাশি রাতের আঁধারে চলে অসামাজিক কার্যকলাপও।

প্রশাসনের অযত্ন-অবহেলায় এটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়লেও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় হল প্রাঙ্গণে বসে বিভিন্ন মেলার নামে ধান্দা। মেলার ভিতর দোকান বসিয়ে যে টাকা পাওয়া যায়, সেই টাকা যায় অজানা গন্তব্যে। প্রশ্ন জাগে — এ কেবল একটি ভবনের ধ্বংস, নাকি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামকে মুছে ফেলার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে শহীদ জিয়া হলের ইতিহাস, ষড়যন্ত্রের জাল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং একজন সাচ্চা জিয়াপ্রেমিক আনিসুল ইসলাম সানির নিরলস সংগ্রামের গল্প। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শহীদ জিয়া হলের নাম, মর্যাদা এবং অস্তিত্ব রক্ষায় তিনি রাজনৈতিক ও আইনগত লড়াইয়ের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তার কারণেই মূলত শহীদ জিয়া হলটি এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে (১৯৯৬–২০০০) এবং (২০০৮–২০২৪) সময়ে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে ওসমান পরিবারের দোসররা শত চেষ্টা করেও শহীদ জিয়া হলের নাম পরিবর্তন করতে পারেনি। ভগ্নপ্রায় ভবনটি সংস্কারের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আনিসুল ইসলাম সানি।

৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর শহীদ জিয়া হল প্রাঙ্গণে এক বিশাল জনসমাবেশ থেকে অবিলম্বে হলটি সংস্কার করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানান আনিসুল ইসলাম সানি। এ সময় তিনি শহীদ জিয়া হলকে অবিলম্বে সংস্কার না করলে নারায়ণগঞ্জবাসীকে নিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালের ১০ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (বি.ইউ.পি.এস.সি.) ‘নারায়ণগঞ্জ শহর উন্নয়ন কমিটি প্রকল্প’ এর মাধ্যমে চাষাঢ়া বালুর মাঠে ‘টাউন হল’ নামে আজকের এই শহীদ জিয়া হলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উদ্দেশ্য ছিল নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে এখান থেকে। স্থানীয়দের স্বপ্ন পূরণে নির্মিত এই টাউন হল একসময় হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র।

পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জিয়াউর রহমান নিহত হলে, একই বছর ১৯ জুলাই তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে দিয়ে ‘টাউন হল’ উদ্বোধনের জন্য তারিখ ও সময় চূড়ান্ত করা হয়। এ সময় ‘টাউন হল’ নামে উদ্বোধনের ক্ষেত্রে আপত্তি তোলেন বিএনপির অন্যতম অঙ্গসংগঠন জাসাসের তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি, তরুণ বিএনপি নেতা আনিসুল ইসলাম সানি।

তিনি ‘টাউন হল’ এর পরিবর্তে ‘শহীদ জিয়া হল’ নামকরণের প্রস্তাব করলে সর্বসম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ‘শহীদ জিয়া হল’ নামে হলটি উদ্বোধন হয়। সে থেকে অদ্যাবধি শহীদ জিয়া হল চাষাঢ়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শহীদ জিয়া হলটি শামীম ওসমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার আড়ালে ব্যবহার করা হয় টর্চার সেল হিসেবে, যা স্থানীয়ভাবে ‘শামীম ওসমানের টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা এখানে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হতেন। পরিকল্পিতভাবে ভবনটি অযত্ন-অবহেলায় ব্যবহার অনুপযোগী করে ‘মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন’ নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালানো হয়।

২০০১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠনের পর শহীদ জিয়া হল পুনঃসংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এস. এম. হারুনার রশিদের সার্বিক সহযোগিতায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এবং শহীদ জিয়া হল পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে আনিসুল ইসলাম সানি হলটি সংস্কার করেন।

এরপর জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে লড়াই শুরু হয়। এক্ষেত্রেও রেকর্ড সংশোধনের জন্য আনিসুল ইসলাম সানি বাদী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গংকে বিবাদী করে দায়ের করেন দেওয়ানি মোকদ্দমা (দে. মো. নং-১৪৬/০৫)।

প্রয়াত বিশিষ্ট আইনজীবী এম. এ. আজিজ প্রামাণিক বাদীর পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন, তাকে সহযোগিতা করেন তার জুনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। মামলাটি দায়েরের পর আনিসুল ইসলাম সানিকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন তৎকালীন বিএনপি নেতা প্রয়াত আতাহার হোসেন সামসু, বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেন খান (বীর মুক্তিযোদ্ধা), এডভোকেট মোঃ জাকির হোসেন (বর্তমানে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি) ও এডভোকেট সরকার হুমায়ূন কবীর (বর্তমানে যুগ্ম আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি ও সভাপতি, জেলা আইনজীবী সমিতি)।

মামলার রায়ে রেকর্ড সংশোধন করে ‘শহীদ জিয়া হল’ নামে হলটি রেকর্ড করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশে ‘টাউন হল’টি ‘শহীদ জিয়া হল’ নামে রেকর্ডভুক্ত হয়। ফলে নামজারি ও জমাভাগ (মিউটেশন), পর্চা, খাজনা, পৌর ট্যাক্স, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, গ্যাস ও টেলিফোন বিল ইত্যাদি টাউন হলের পরিবর্তে ‘শহীদ জিয়া হল’ নামে সংশোধিত হয়।

এ কারণে শত চেষ্টা করেও শহীদ জিয়া হলের নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা মনোবাসনা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ভেস্তে গেছে শেখ হাসিনা ও কুখ্যাত ওসমান পরিবারের সব ষড়যন্ত্র।

২০০৮ সালে পুনরায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে টানা ১৬ বছর শত চেষ্টা করেও ‘শহীদ জিয়া হল’-এর নাম পরিবর্তন করতে পারেননি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর জাসাস আয়োজিত মহাসমাবেশ থেকে আনিসুল ইসলাম সানি স্পষ্ট ঘোষণা দেন — “শহীদ জিয়া হল আমাদের অহংকার। এর মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।”

তার প্রধান দাবি ছিল, অবিলম্বে শহীদ জিয়া হলের সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা।

এক বছর পার হলেও প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে হলটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রতিদিনই হল প্রাঙ্গণে চলছে মেলার নামে দোকান ভাড়া, অথচ সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। এতে ক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জবাসী। তাদের মতে, এটি কেবল ভবন নয়, শহীদ জিয়ার নাম-স্মৃতি বহনকারী একটি প্রতীক।

শহীদ জিয়া হল প্রসঙ্গে আনিসুল ইসলাম সানির বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “শহীদ জিয়া হল সংস্কারের ব্যবস্থা যে কেন নিচ্ছে না, তা আমরা বুঝতে পারছি না। হলটি সংস্কারের ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যেকোনো মূল্যে শহীদ জিয়া হলকে সংরক্ষণ করতেই হবে। এ হলটি আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল, একটি ইতিহাস।”

নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা — সরকার তথা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আর সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত হলটি সংস্কারের পদক্ষেপ নেবেন। প্রয়োজনে হলটি পুনঃনির্মাণ করে একটি অত্যাধুনিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হিসেবে নতুন আঙ্গিকে ‘শহীদ জিয়া হল’কে সাজাতে হবে।

যাতে থাকবে মাটির নিচে পার্কিংয়ের জন্য দ্বিস্তরবিশিষ্ট বেজমেন্ট, ১,২০০–১,৫০০ আসনের একটি ও ৭০০–১,০০০ আসনের আরেকটি অডিটোরিয়াম, এক বা একাধিক আর্ট গ্যালারি, ছোট-বড় চার থেকে পাঁচটি কনফারেন্স রুম এবং ১০–১৫টি মহড়া কক্ষ। মোদ্দাকথা, ‘শহীদ জিয়া হল’ হবে বাংলাদেশের একটি অন্যতম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *