
ঢাকার অভয় দাস লেনে ভোলানন্দ গিরি আশ্রম। সেখানেই সান্ধ্য আরতি বা প্রার্থনায় বসেছেন জনা বিশেক সনাতন ধর্মের অনুসারী। প্রার্থনা শেষে কথা হয় তাদেরই একজন সুস্মিতা দেবীর সঙ্গে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে, সুস্মিতা দেবী জানালেন মন্দিরে নিয়মিত এলেও এখন একটা ‘ভয় ঢুকে গেছে মনে’।
হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘ব্যাপক ক্ষোভের’ কারণ কী :
সাম্প্রতিককালে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে সনাতন ধর্মানুসারীদের বিভিন্ন সমাবেশে যেভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, তাকে সংখ্যালঘু নেতারা ব্যাখ্যা করছেন ‘ব্যাপক ক্ষোভের’ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
আন্দোলনের সংগঠকরা জানাচ্ছেন, আন্দোলনে যেন কোনো রাজনৈতিক চোহারা না থাকে, কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য তারা সচেতন আছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নির্মল বিশ্বাস বলেন, ‘যারা আগে রাজনৈতিক পদধারী ছিলেন বা রাজনীতির লেবেল আছে, তাদের আমরা সামনে আনছি না। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেও সামনে আসছেনও না। যারা বিভিন্ন সময় সরকারদলীয় ছিলেন, তাদের আমাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার নাই। আমরা আমাদের মতো রাজপথে আন্দোলন করে যাব, তারা যেন বিঘ্ন তৈরি না করেন।’
কিন্তু এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চান তারা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আন্দোলন যেন বিতর্কিত না হয় সে জন্যই তারা রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের দূরে রাখছেন। অনেকে হয়তো এটা বলবে যে আওয়ামী লীগ সরকারকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন করছে সংখ্যালঘুরা। আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করছি না। কিন্তু রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা এখানে থাকলে আমাদের ট্যাগ দিয়ে দমন করার ষড়যন্ত্র হতে পারে। আমাদের তো দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনো টার্গেট বা অভিপ্রায় নেই। কারো ইন্ধনেও আমরা রাজপথে নামি নাই। আমরা মাঠে নেমেছি শুধু আমাদের ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’
আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’ তকমা কাটাতে চান হিন্দু নেতারা :
সংখ্যালঘু জোটের আন্দোলনে যে ৮ দফার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো অবশ্য নতুন নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন এসব দাবি বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো একসঙ্গে করে ৮ দফা দাবি নামে এর বাস্তবায়ন চান হিন্দু নেতারা। যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারে তদন্ত কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন কিংবা আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণের পাশাপাশি দুর্গাপূজায় পাঁচ দিনের ছুটি চাওয়া হয়েছে।
কিন্তু এই আন্দোলন এমন একটি সময়ে হচ্ছে, যখন নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। ফলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনি আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে হিন্দুদের উল্লেখ করে এই আন্দোলনের পেছনে ‘ভারত বা আওয়ামী লীগের উসকানি আছে’ এমন প্রচারণাও আছে।
যদিও এসব প্রচারণাকে নাকচ করে দিচ্ছেন সংখ্যালঘু নেতারা। বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুমন কুমার রায় বলেন, ‘তাদের যে দাবি সেটা মানতে আওয়ামী লীগ সরকার তো বটেই অতীতের কোনো সরকারই কোনো সদিচ্ছা দেখায়নি। ২০০১ সাল থেকে আজকে ২০২৪ সাল। হিন্দুদের ওপর যতগুলো অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে, একটা ঘটনারও সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার কোনোটাই হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৬ বছর ক্ষমতায়, আমরা ভেবেছিলাম, তারা আমাদের দাবিকে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু বাস্তবে আসলে কিছুই হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বলা হয় যে আওয়ামী লীগ হিন্দুবান্ধব, হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। কিন্তু তার প্রতিফলন তো আমরা দেখিনি। আবার হিন্দুদের সবাই যে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে বিষয়টাও তেমন না। তাহলে সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামের মতো বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতারা অতীতে কিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন? তারা তো অবশ্যই হিন্দুদের ভোট পেয়েছেন। সুতরাং হিন্দুরা শুধু আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, এটা আমি মনে করি অমূলক ধারণা।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেকোনো নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুরা সব দলের কাছেই বলির পাঠায় পরিণত হন। ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যদি হেরে যায়, তাহলে তারা এসে হিন্দুদের মারধর করে, অগ্নিসংযোগ করে, ভাঙচুর করে। বলে যে মালাউনেরা ভোট দেয়নি এ জন্য হেরে গেছি। আবার বিএনপি প্রার্থীও হেরে গেলে তারাও বলে যে এই মালাউনেরাই আমাদের ভোট দেয়নি, সে জন্য হেরি গেছি। অতএব রাজনৈতিকভাবে আমরা যেন একটা বলির পাঠা।’
আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কথায় এটা স্পষ্ট যে হিন্দুদের ওপর ‘আওয়ামী লীগের সমর্থক’ কিংবা ‘ভারতপন্থী যে তকমা’ সেটার অবসান ঘটাতে চান তারা। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে? এমন প্রশ্নে আন্দোলনের নেতারা বলছেন, তারা এখন চেষ্টা করছেন রাজনীতির বাইরে থাকার। তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, অতীতে হিন্দু সম্প্রদায়েরও অনেকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ না দেখে বরং হিন্দু পরিচয়কে দলীয় রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। এতে ওই সব নেতারা লাভবান হলেও হিন্দুদের কোনো দাবি পূরণ হয়নি। বরং হিন্দুরা বিভিন্ন সময় ‘নির্যাতনের শিকার’ হয়েছেন।
গত ৪ অগাস্ট, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংখ্যালঘু জোটের সর্বশেষ যে সমাবেশ হয়েছে, সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রামের ইসকন নেতা এবং পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বলেছেন, ‘হিন্দুদের আর কেউ নির্দিষ্ট কোনো দলের লেজুড়বৃত্তিতে ব্যবহার করতে পারবে না। আমরা এখন থেকে পুরো বাংলাদেশে ভোটের আগে যারা আমাদের অধিকার নিয়ে, আমাদের দাবি নিয়ে কাজ করবেন, আমরা সমন্বিতভাবে তাদেরকেই ভোট দেব। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি আমরা হিন্দুরা কেউ করব না। যারা হিন্দু নাম নিয়ে এটা করতে চাইবে, আমরা তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করব।’
৮ দফা দাবি নিয়ে সরকার কী বলছে :
এবার পূজার আগে সরকার এক দিনের ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি ছিল পূজা উপলক্ষে পাঁচ দিন ছুটি দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা হয়নি। এ ছাড়া পুরো ৮ দফা নিয়েও আলাদা কোনো আশ্বাস সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পায়নি বলে জানাচ্ছেন নেতারা। যদিও সংখ্যালঘু নির্যাতন, পূজায় নিরাপত্তাসহ বিভিন্নভাবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আলোচনার কথা জানা যাচ্ছে।
কিন্তু নির্দিষ্টভাবে ৮ দফা পূরণের বিষয়ে সরকার আসলে কী ভাবছে? জানতে চাইলে ধর্ম উপদেষ্টা অবশ্য জানিয়েছেন, এসব দাবি সরকারের বিবেচনায় আছে। তিনি বলেন, ‘উনারা দাবি জানিয়েছেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সনাতম ধর্ম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। আমাদের সময় কম। এগুলো করতে গেলে নির্বাচিত সরকার লাগে, সময় লাগে। আমরা তো ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট। বিতর্ক তৈরি হয় এ রকম কোনো কাজে সরকার এখন হাত দিচ্ছে না। আর যেগুলো সময়সাপেক্ষ সেগুলো এক দিনে হয় না। দৈনন্দিন কাজ করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। উনারা দাবি জানিয়েছেন। এগুলো সরকারের বিবেচনায় আছে।’