এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ ও উত্তরণে করণীয় সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা

মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী, ব্যুরো চিফ

২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় পাসের হার মাত্র ৫২ শতাংশ, যা ঢাকা বোর্ডের ৬৪ শতাংশ এবং জাতীয় গড় ৫৮ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। জেলার শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ফলাফল শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের “বিপর্যয়” সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি উত্তরণে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেলার বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে এক বিশেষ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) সকাল ১১টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শোয়াইব আহমাদ খান বলেন, “করোনা ও ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে।” তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে পাবলিক পরীক্ষার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ মোতায়েন করতে হয় না। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকরা একযোগে কাজ করলে পরিস্থিতি বদলাবে।

বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, “ম্যানেজিং কমিটিতে অশিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির দায় শিক্ষা বোর্ডের নয়। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে যে নামগুলো আমাদের কাছে আসে, আমরা শুধু অনুমোদন দিই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেরই জানা উচিত, কারা শিক্ষিত ও যোগ্য।”

অনুষ্ঠানে শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, এইচএসসি ফল বিপর্যয় নিয়ে দেশে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। মতবিনিময় সভায় নারায়ণগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফজলুল হক রুমন রেজা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “করোনাজনিত শিখন ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বিমুখতা, মোবাইল আসক্তি ও কোচিং নির্ভরতা এই খারাপ ফলাফলের মূল কারণ।” করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় শিক্ষার মানে স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, “অটো পাস ও সিলেবাস সংকোচনের ধারাবাহিকতা শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি অনাগ্রহ বাড়িয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ২০২৪ সালের সহিংস ঘটনাবলিও শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।”

জেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, ইংরেজি, আইসিটি ও হিসাববিজ্ঞানে সর্বাধিক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। তারা বলেন, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট, শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি এবং দুর্বল ক্লাস পরিবেশ এর অন্যতম কারণ। এছাড়া নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপও ফলাফলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। কিছু শিক্ষক সিন্ডিকেটভিত্তিক কোচিং কার্যক্রম পরিচালনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

সমাধানের প্রস্তাব হিসেবে অধ্যক্ষ রুমন রেজা বলেন, “শিখন ঘাটতি পূরণে রিমিডিয়াল ক্লাস চালু, ক্লাসে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ এবং কোচিং নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করলেই এই সংকট কাটানো সম্ভব।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, “নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফলাফল, পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে শিক্ষা খাতে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি।” তিনি আরও প্রস্তাব করেন, জেলা শিক্ষা অফিসের তত্ত্বাবধানে একটি ‘নারায়ণগঞ্জ শিক্ষা উন্নয়ন টাস্কফোর্স’ গঠন করা হোক, যা নিয়মিতভাবে ফলাফল পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও সুপারিশ প্রকাশ করবে। তিনি বলেন, “ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা দূর করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন।”

সভায় উপস্থিত একজন অভিভাবক বলেন, “স্কুল হচ্ছে শিক্ষা বিস্তারের কারখানা। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষকরা ডাকলেও আমরা অভিভাবকরা যাই না। আমাদের উচিত সন্তানরা ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে কিনা তা খোঁজ নেওয়া। শিক্ষকদেরও উচিত শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া।”

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, “নারায়ণগঞ্জে ২২ হাজার এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ফেল করেছে। এই চিত্র আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমাদের মতো দেশে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলে, সেই বোঝা আমরা কীভাবে বহন করব?”

তিনি আরও বলেন, “আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, দায়িত্ব নিতে চাই। এমন প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যেখানে শিক্ষা হবে আনন্দের, উৎসবের। শুধু পাশ করানো নয়, আমরা চাই প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে।”

অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “সন্তানদের শুধু শিক্ষকের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। আপনাদেরও সময় দিতে হবে, নজর রাখতে হবে।”

শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান সমস্যা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, “এসব সমস্যা ধীরে ধীরে সমাধান করা হবে।” শিক্ষকদের উদ্দেশে জেলা প্রশাসক বলেন, “আমরা যাদের পড়াচ্ছি, তারা কি আমাদের অনুকরণ করছে? আমরা কি অনুসরণীয় হতে পারছি? আমি বললেই সম্মান আসবে না; যোগ্যতা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে।” তিনি যোগ করেন, “আমাদের শিক্ষকরা যোগ্য, তবে আন্তরিকতা আরও বাড়াতে পারলে সমাজের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব।”

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, “শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ যদি একসাথে কাজ করতে পারে, তাহলে এই ফল বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।”

উক্ত সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. আ. ফ. ম. মশিউর রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাছলিমা শিরিন, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসকুল ইসলাম রাজিব, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু সাঊদ মাসুদ, দৈনিক স্বাধীন সংবাদ পত্রিকা ও ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া নারায়ণগঞ্জ জেলার ব্যুরো চিফ মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মাঈনুদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহসহ জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *