আবুল কালাম আজাদ:
“স্বাধীন সংবাদ অনুসন্ধান”: পর্ব-০১
কক্সবাজারে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ জালিয়াতির ঘটনায় আলোচনায় এসেছে পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের সাহিত্যিকাপল্লী এলাকা। এখানে স্ব পরিবারে বসবাস করছেন রোহিঙ্গা যুবক মহিউদ্দিন (৩৪)। অভিযোগ উঠেছে, জীবিত মা–বাবাকে মৃত দেখিয়ে তিনি ভুয়া তথ্য সংযোজন করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিচয় অর্জন করেছেন এবং সম্প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করেছে।
সাহিত্যিকাপল্লী এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মহিউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের সাথে মিশে বসবাস করছেন। প্রতিবেশীরা জানান, তিনি নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন এবং নিজেকে স্থানীয় নাগরিক হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তান।
স্থানীয়দের দাবি,বিগত ২০০৭ সালে ছবি যুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র করা কালীন সময়ে মহিউদ্দিনের মা বাবা রোহিঙ্গা হওয়ায় তৎকালীন জনপ্রতিনিধিরা ভোটার করেনি। সেই প্রেক্ষিতে ভোটার হতে নিজের মা বাবার এনআইডি সংযুক্ত করার বিধান থাকায় সরকারি কাগজপত্রে মহিউদ্দিন নিজের বাবা–মাকে মৃত দেখিয়ে ভুয়া তথ্য সংযোজন করেছেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিচয় ও এনআইডি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
স্বাধীন সংবাদের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর কক্সবাজার পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড থেকে জন্মসনদ সংগ্রহ করেন রোহিঙ্গা যুবক মহিউদ্দিন এবং ২০১৭ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলার নাগরিক পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন তিনি। ঠিক একইভাবে তথ্য গোপন করে মহিউদ্দিনের আপন বোন মরিয়ম সোলতানা পুতু ২০১৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন। তাদের ভাই-বোনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মহিউদ্দিন নিজের এনআইডিতে বাবা-মা কে মৃত দেখালেও তার বোন জীবিত দেখিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ওমর সিদ্দিক লালুর কাছ থেকে জীবিত পিতা-মাতার মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করেছেন মহিউদ্দিন। সেই মৃত্যু সনদ দিয়েই বানানো হয়েছে তার জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র।
শুধু মহিউদ্দিন নয় তার মতো এমন বহু রোহিঙ্গা নাগরিক মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কক্সবাজার পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে জন্মসনদ নিয়ে বানিয়েছেন জাতীয় পরিচয়পত্র। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দালালদের মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে তাদের জন্মসনদ তৈরী করে দিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা যুবক মহিউদ্দিন কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরিচয় গোপন রেখে তার মা-বাবা জীবিত আছে কিনা তা জানতে হাজির হই তাদের বাড়িতে, এসময় তার মা বাড়িতে আছে কি না জানতে চাইলে মহিউদ্দিন কৌশল অবলম্বন করে বলেন তার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। অর্থাৎ তার মা এখনো জীবিত আছে। তাই তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হলে ৪-৫ দিন পরে আসতে হবে বলে জানান তিনি।
এ ঘটনায় স্থানীয় সচেতন মহল তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, এভাবে রোহিঙ্গারা ভুয়া তথ্য দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিতে থাকলে তা দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন “আমরা অবাক হয়েছি, কিভাবে রোহিঙ্গারা সরকারি কাগজপত্রে বাংলাদেশি পরিচয়পত্র নিচ্ছে। প্রশাসন যদি কঠোর না হয়, ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।”
অত্র ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার শহীদুল্লাহ্ বলেন ২০০৭সালে যখন ছবিযুক্ত এনআইডি বানানো শুরু করেছিল সরকার তখন মহিউদ্দিনের বাবা আব্দুল হক ওরফে ভূতা মাঝি ভোটার হওয়ার জন্য চেষ্টা করলেও সে রোহিঙ্গা হওয়ায় আমি তার নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিনি। সম্প্রতি জানতে পেরেছি তার ছেলে মহিউদ্দিন এবং মেয়ে মরিয়ম সোলতানা পুতু দুজনেই পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড থেকে জন্মসনদ সংগ্রহ করেছে এবং তারা ইতোমধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করেছেন। এসময় তিনি বলেন তাদের জন্মসনদ পাওয়ার পেছনে সরাসরি জড়িত রয়েছে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ওমর সিদ্দিক লালু।
মহিউদ্দিন এবং তার বোন মরিয়ম সোলতানা পুতুর এনআইডি বাতিলের জন্য ইতোমধ্যে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার বরাবর আবেদন করেছেন কক্সবাজার জেলা রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি। এমন একটি আবেদনপত্র ইতোমধ্যে স্বাধীন সংবাদের অনুসন্ধানী টিমের হাতে এসে পৌছেছে।
বিষয়টি নিয়ে কক্সবাজার পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার ওমর সিদ্দিক লালুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোন তথ্য নেই এবং তার ওয়ার্ড থেকে কোন রোহিঙ্গা নাগরিককে সনদ দেওয়া হয়নি। তবে স্থানীয়দের দাবি, লালু কমিশনার থাকার সময় তার ওয়ার্ডের জন্মসনদ ব্যবহার করে বহু রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পরিচয়পত্র তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন ও তার বোনও রয়েছেন, যারা বর্তমানে সাহিত্যিকাপল্লী এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ ফয়সাল আলম বলেন,“যদি কোন রোহিঙ্গা ভোটার হয়ে থাকে তাহলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ফরোয়ার্ডিং পাঠালে আমরা এনআইডি বাতিলের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।”
কক্সবাজার পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন যদি এ অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তার জন্মসনদ বাতিল করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। নাগরিক পরিচয়ের ভুয়া সনদ নিয়ে রোহিঙ্গারা যদি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, তবে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে— যেখানে একজন বাংলাদেশের নাগরিক কে জন্মসনদ, এনআইডি পেতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় সেখানে কীভাবে ভুয়া তথ্য দিয়ে একজন রোহিঙ্গা যুবক এত সহজেই নাগরিকত্বের পরিচয় ও এনআইডি সংগ্রহ করলেন? প্রশাসনের নীরবতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশের কারণে এই দুর্বলতা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।