বরিশাল বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক সৌরভ কুমারের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও ঘুষ ব্যবসা

স্টাফ রিপোর্টার:

ফরিদপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা সৌরভ কুমার সাহা ২০১৪ সালে বিআরটিএর মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরিতে যোগ দেন। তার চাকরির শুরু হয় সংস্থার নোয়াখালী কার্যালয়ে, যেখানে কৌশল ও সুযোগের মিলনে তার ভাগ্য বদলে যায়। এরপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন।

সৌরভের বাবা ছিলেন পত্রিকার হকার। সীমিত আয়ে পরিবার পরিচালনা করা ছিল প্রতিদিনের সংগ্রাম। তবে আওয়ামী পরিবারের প্রভাব সৌরভকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায়। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সুপারিশে, তিনি বিআরটিএর চাকরি পান। এরপর মাত্র ১১ বছরে তিনি নিজের নাম ও আত্মীয়স্বজনের নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ সঞ্চয় করেছেন।

বর্তমানে সৌরভের সম্পদে রয়েছে ১০টি বাস, চারটি প্রাইভেট কার, এবং বেশ কয়েকটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা। ফরিদপুরে তার ভগ্নিপতি এই অটোরিকশাগুলো দেখাশোনা করেন। এছাড়া নিজের চলাচলের জন্য তিনি কিনেছেন অর্ধ কোটি টাকার বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি।

সূত্র জানায়, আওয়ামী পরিবারের পরিচয় ও স্থানীয় প্রভাবের কারণে সৌরভ দ্রুত পদোন্নতি পান। মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে মোটরযান পরিদর্শক পদে উন্নীত হয়ে তিনি ঢাকার উত্তরা, গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় চাকরি করেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের শুরুতে তিনি বরিশাল বিআরটিএর ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন।

ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস থেকে অবৈধ উপার্জন

সৌরভ কুমারের মূল আয়ের উৎস ছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন। তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ২৬–২৭ হাজার টাকা। তবে ঘুষবাণিজ্য থেকে তার মাসিক আয় ৩০–৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

বরিশাল বিআরটিএর অধীনে প্রতি মাসে ছয় থেকে আটটি লাইসেন্স বোর্ড বসে। প্রতিটি বোর্ডে প্রায় ১৮০–২০০ জন পরীক্ষা দেন। তবে বোর্ডে মাত্র কয়েকজনকে পাস করা হয়। পরবর্তী ধাপে সৌরভ ও তার ব্যক্তিগত ড্রাইভাররা (রিয়াজ খান, আলাউদ্দীন, জাকির, আসাদুল, হৃদয়সহ ২০–২৫ জন) পরীক্ষায় ফেল হওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, পাস করানোর জন্য তিন-চার হাজার টাকার চুক্তি করেন। এর মধ্যে লাইসেন্সপ্রতি আড়াই হাজার টাকা সৌরভ গ্রহণ করেন, বাকি টাকা যায় দালালদের কাছে।

কিছু পরীক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকতেন না বা প্রতিনিধি পাঠাতেন। এই সুযোগে সৌরভ নিজের তালিকায় ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর করিয়ে নেন। এভাবে লাইসেন্স ও মাঠ পরীক্ষার বাণিজ্যে তার অবৈধ লেনদেন চলত। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বোর্ড থেকে তিনি ৫–৬ লাখ টাকা অবৈধভাবে আয় করতেন।

সিএনজি ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন থেকে ঘুষ

সূত্র জানায়, সৌরভ সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফাইলপ্রতি ৪০–৫০ হাজার টাকা, ট্রাকের জন্য ৫–১০ হাজার টাকা এবং মোটরসাইকেলের জন্য ১–১.৫ হাজার টাকা ঘুষ নিতেন। এছাড়া বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও সিএনজির ফিটনেস থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় হতো।

২০২৩ সালে, বিআরটিএ প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদন না আসার আগেই তিনি ১৯১টি সিএনজি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি সিএনজি থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর বরিশাল দুদক কর্মকর্তা রাজকুমার সাহা বাদী হয়ে সৌরভকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলায় সহকারী পরিচালক রোকনুজ্জামান এবং ‘রানার অটো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়।

হাওলাদার পরিবহন ও বাস ব্যবসা

সৌরভের হাওলাদার পরিবহন ব্যবসার মাধ্যমে তিনি বরিশাল ও ফরিদপুরে বাস পরিচালনা করেন। এছাড়া আশিক পরিবহন ও ফরিদপুর বাস মালিক সমিতির মাধ্যমে আরও বাস নিয়ন্ত্রণ করেন। মাদারীপুরের মোস্তফাপুর স্ট্যান্ডের চেকার জানান, সৌরভ হাওলাদার পরিবহন কিনেছেন বাবা ও শ্বশুরের নামে। ব্যবসার লেনদেন ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ তার হাতে।

হাওলাদার পরিবহনের সহকারী ম্যানেজার প্রদীপ কুমার বাড়ৈ সাংবাদিকদের জানান, বাস কাউন্টার মূলত রিয়াজ খান দেখাশোনা করেন। তিনি স্বীকার করেন, সৌরভ বাসের প্রকৃত মালিক। রিয়াজের মাধ্যমে কিস্তিতে গাড়ির টাকা পরিশোধ করা হয়। সম্প্রতি সৌরভ দুটি পুরোনো গাড়ি বিক্রি করে নতুন তিনটি বাসের চেচিস ও ইঞ্জিন কিনেছেন।

মাঠ পর্যবেক্ষণ

২৯ সেপ্টেম্বর, নথুল্লাবাদ বিআরটিসি কাউন্টারে লাইসেন্স পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মোটরসাইকেল ও চার চাকার যানবাহনের মাঠ পরীক্ষা চলাকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকলেও কেবল হাতে কয়েকজন প্রার্থী পরীক্ষা দেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, যাদের পাস করানো প্রয়োজন মনে হয়েছে, তাদের পাস দেওয়া হয়েছে।

সৌরভের প্রতিক্রিয়া

সৌরভ কুমার সাহাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তার নামে কোনো বাস নেই। প্রাইভেট কার তার বাবার নামে। হাওলাদার পরিবহন ও আশিক পরিবহনের বাসও তার নয়। আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদ ক্রয় করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *