সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ সরদারের অপকর্মের আমলনামা

স্টাফ রিপোর্টার: 

বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার ১ নং বড় বাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মাসুদ সরদারকে ঘিরে উঠেছে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ভয়াবহ সব অভিযোগ। আওয়ামী লীগ মনোনীত হয়ে ২০১৬ সালে নির্বাচিত এই চেয়ারম্যান বিগত প্রায় এক দশকে গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার অবৈধ সাম্রাজ্য—যার মধ্যে রয়েছে গোপালগঞ্জে বিলাসবহুল বাড়ি, একাধিক ট্রাক, প্রাইভেট কার, দোকানভবন, এবং ব্যাংকে বেনামি একাউন্টে বিপুল টাকা।

সরকারি সম্পদ লুটপাট: প্রকল্পের নামে আত্মসাৎ:

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাসুদ সরদার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ আত্মসাৎ করেছেন। যেমন—নালুয়া বাজার থেকে বড়গুনি বাজার পর্যন্ত এলজিইডি রাস্তার পাশের প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করে বিক্রি করেছেন। এর ফলে প্রায় ৪০০ ফুট রাস্তা ভেঙে পড়ে, যানচলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ নিয়ে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দায়ের হলেও, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সেটি স্থগিত করে দেওয়া হয়।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘোলা কেন্দ্রীয় কবরস্থানে এমপি বরাদ্দের ৮০ মেট্রিক টন বালু ভরাটের বরাদ্দ থাকলেও কোনরকম আলোচনা ছাড়াই নামমাত্র কাজ করে পুরো বরাদ্দ আত্মসাৎ করেন তিনি।

এছাড়াও ২০১৮ সালে বড়গুনী বড় মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থান ও বড়গুনী খাল পুনঃখননের জন্য বরাদ্দকৃত মোট ৬৪ মেট্রিক টন চালের মধ্যে বড়জোর ৫ মেট্রিক টন কাজে লাগানো হয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি। বাকি চালের হদিস মেলেনি।

ভাতা ও প্রধানমন্ত্রীর ঘর প্রকল্পেও দুর্নীতি:

সরকারি ভাতা যেমন বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতা—এসবের বরাদ্দ পেতে হলে প্রতিটি উপকারভোগীকে ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ঘর প্রকল্পের ঘর পেতে ১৫ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে বলে একাধিক ভুক্তভোগী জানান। ঘর বরাদ্দের নামে হতদরিদ্রদের কাছ থেকে এভাবে অর্থ আদায় করে সেটি আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান।

করোনাকালীন সহায়তা লুট:

চেয়ারম্যান মাসুদ সরদার করোনা মহামারির সময় প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত নগদ সহায়তা তার স্ত্রী দীপা, শ্যালক সাইফুল শেখ, সাজ্জাদ শেখ, আজাদ, আরমান এবং শ্বশুর-শাশুড়ির নামে উত্তোলন করেছেন। এই টাকায় শ্বশুরবাড়ির টিনের ঘর ভেঙে তৈরি করা হয় বিলাসবহুল ভবন।

বেনামে সম্পদ: ৬ কোটির বাড়ি ও একাধিক যানবাহন:

চিতলমারী উপজেলার বড়গুনী গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মাসুদ সরদার মাত্র দুই বছরেই গোপালগঞ্জ শহরের ধীরেন্দ্রনাথ বাগচীর বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় পাঁচতলা বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেন। ওই ভবনের ভিত্তি আটতলা পর্যন্ত হলেও এখনো পাঁচতলায় থেমে আছে। এর নির্মাণে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। এছাড়াও গুদামঘর, ১৫টি দোকানঘর, ৫টি ট্রাক, ৪টি মাইক্রোবাস, ২টি প্রাইভেটকার এবং ব্যাংকে পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখার তথ্য পাওয়া গেছে।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে কোটা দখল:

অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান মাসুদ সরদার তার পিতা মোঃ নিয়ামত আলী সরদারকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলছেন। শুধু তাই নয়, ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবহার করে তার ভাই মোঃ রইজ সরদার পুলিশে চাকরি পেয়েছেন, বর্তমানে ফরিদপুর জেলায় কর্মরত।

শালিশ বানিজ্য, চাঁদাবাজি ও মাদক মামলার ভয়:

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মাসুদ সরদার প্রায়ই গ্রাম্য সালিশের নামে অর্থ আদায় করেন। উদাহরণস্বরূপ, খগড়াবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা উত্তম রায়ের কাছ থেকে একটি অভিযোগের শালিশ করে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা আদায় করেও ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানে দেননি। তদুপরি, তার বিরোধীদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি, মাদক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় ও ত্রাস সৃষ্টি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ভয়ভীতি প্রদর্শন:

অভিযোগ রয়েছে, মাসুদ সরদার তার রাজনৈতিক পরিচয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইউনিয়নের বিভিন্ন উন্নয়নকাজে হস্তক্ষেপ করেন এবং মেম্বারদের কোনো মতামত গ্রহণ না করেই এককভাবে কাজ ভাগ করে নেন ও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দ আত্মসাৎ করেন।

এলাকাবাসীর দাবি:

উপজেলা ও ইউনিয়নজুড়ে সাধারণ মানুষ বলছেন, মাসুদ সরদারের কর্মকাণ্ড শুধু ইউনিয়নের উন্নয়ন ব্যাহত করছে না, বরং সরকার ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তারা এ ব্যাপারে দ্রুত দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। জানা যায়, তার বিরুদ্ধে চিতলমারী থানায় ধর্ষণচেষ্টাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।


তদন্ত দাবি ও পরিশেষে:

বড়বাড়ীয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ মাসুদ সরদারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই ধরনের অপশাসন ও দৃষ্টান্তহীন দুর্নীতি আরও বিস্তৃত হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *