স্বাধীন সংবাদ প্রতিবেদক:
খুলনা বিভাগের সুন্দরবন বনাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই চলমান দুর্নীতি ও অবৈধ কার্যকলাপ নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত সুন্দরবন, যেখানে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্ভর করে, সেখানে বনরক্ষী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দূর্নীতি বন এবং পরিবেশের জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে অভিযোগ উঠেছে, বনরক্ষীরা ঘুষ নিয়ে বনসম্পদের ব্যবহার ও সংরক্ষণে অনিয়ম করছেন। গোলপাতা সংগ্রহ মৌসুমে এই দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি নজরে আসে। বাওয়ালিরা জানান, বনরক্ষীদের ঘুষ না দিলে গোলপাতা সংগ্রহ সম্ভব নয়, ফলে অনেক সময় ডাকাত ও অবৈধ ব্যবসায়ীও এতে অংশ নেন। অভিযোগ রয়েছে, বনকর্মকর্তা, স্থানীয় সমন্বয়কারী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে চক্রবৃত্তির মাধ্যমে এই দুর্নীতি চালু আছে, যা সুন্দরবনের সম্পদকে ক্ষয় করছে এবং স্থানীয়দের জন্য লাভজনক হয়নি।
গবেষণা ও স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক ৯২ দিনের বন বন্ধকালে বনাঞ্চলে অপরাধের হার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে বিষ দিয়ে মাছ ধরা এবং হরিণ শিকার এ সময়ে বেড়ে যায়। দুর্নীতিগ্রস্ত বনরক্ষীরা মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে নদী ও খালে বিষ ছড়ানোর অনুমতি দেন, যা সুন্দরবনের জলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এতে অপরাধী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইও দেখা দেয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বনরক্ষীরা বন সংরক্ষণের পরিবর্তে অন্যায় কার্যকলাপে সহযোগিতা করছেন। আগুন লাগানোর ঘটনাও তেমনই উদ্বেগজনক। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা বনকর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে বনাঞ্চলের বিভিন্ন অংশে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগাচ্ছেন। এতে বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, খুলনার এক বন বিভাগের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৫৭ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা বন লুটের চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে।
সুন্দরবনের স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবিকা এই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। বন বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে সব মানবিক কার্যকলাপ বন্ধ থাকে, যাতে প্রজনন মৌসুম রক্ষিত হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুর্নীতি ও অনিয়ম না বন্ধ হলে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না এবং বন ও পরিবেশের ক্ষতি অব্যাহত থাকবে।
স্থানীয়রা দাবি করছেন, সরকারকে অবিলম্বে সুন্দরবনের দুর্নীতি, বনরক্ষীদের ঘুষ এবং অবৈধ কার্যকলাপের স্বচ্ছ তদন্ত চালাতে হবে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন, যদি এই অব্যবস্থাপনা চলতে থাকে, তাহলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব ও দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুন্দরবনের পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের জীবিকা রক্ষার জন্য দুর্নীতি নির্মূল করা, বনরক্ষীদের কার্যক্রম নজরদারি করা এবং অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা এখন সময়ের অন্যতম জরুরি দাবি। অনিয়ম বন্ধ না হলে শুধুমাত্র বনাঞ্চল নয়, সমগ্র অঞ্চলের পরিবেশগত নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্যও বিপন্ন হবে।