নিজস্ব প্রতিবেদক :
টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ি) আসনটি ১৯৮১ সালের পর থেকে অধ্যবধি পর্যন্ত একচেটিয়া আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। বিএনপি’র সাবেক দ্বিতীয় মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, ধনবাড়ি রাজ পরিবারের সন্তান আসিকা আকবর এবং বিশিষ্ট শিল্পপতি ফকির মাহবুব আনাম স্বপন বারবার ধরাশায়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর আসনটি পুনরুদ্ধারের সুযোগ এসেছে বিএনপির সামনে, কিন্তু দলীয় কোন্দল, গ্রুপিং ও নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় দলটি খুব বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তাছাড়া, বিএনপির থেকে বারবার মনোনয়ন পাওয়া বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনান (স্বপন ফকির) ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারের এমপি-মন্ত্রিদের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় এবং তাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ায় তৃণমূল বিএনপির মধ্যে হতাশা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মামলা, হামলা, জেলজুলুম ও নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের সামান্যতম খোঁজখবর রাখেননি বিএনপির এই হেভিওয়েট নেতা।
এই সুযোগটি কাজে লাগাতে মাঠে মরিয়া হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ জামায়াতুল ইসলামী।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানান, টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন (স্বপন ফকির)-এর বিরুদ্ধে টাঙ্গাইল-২ (ভুয়াপুর-গোপালপুর) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছোট মনিরকে সংবর্ধনা প্রদানের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিগত ১৬ বছরে ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ সরকারের এমপি ও মন্ত্রিদের সঙ্গে আঁতাত করে চলায় তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা-মোকদ্দমা নেই। এর পরেও তিনি বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তার প্রভাবের কারণে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মামলা ও হামলার শিকার ত্যাগী বিএনপি নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
মধুপুর-ধনবাড়ী এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, গত ৫ আগস্টের পর স্বপন ফকির আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতাকর্মীর, যারা বিগত ১৬ বছর বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা, হামলা ও নির্যাতন করেছে, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার অভিযোগ ইতিমধ্যে বিএনপির হাইকমান্ডকে পাঠানো হয়েছে।
স্বপন ফকিরের টাঙ্গাইল-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী এমপি ছোট মনিরের পাশে বসে হাজার হাজার জনতার মাঝে এক ভিডিওতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ জানানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। গত ১৬ বছর টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য-মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে আঁতাত করে জামাই আদরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন স্বপন ফকির। তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, ২০২৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাকির সরকারের ভাই মজিদ সরকার অরণখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কেন্দ্র কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। জাকির সরকার কাকরাইদের সরকার বাড়িতে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলীর পক্ষে উঠান বৈঠক করেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ধনবাড়ী উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আজিজ ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে এবং সাবেক এমপি ও মন্ত্রিকে প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর সঙ্গে আঁতাত করেই তিনি তাঁর শিক্ষকতার পদ আগলে রাখেন। এই জাকির সরকার এবং অধ্যক্ষ আজিজকে এখন স্বপন ফকিরের এলাকার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পৌর বিএনপির সভাপতি খুররম খান ইউসুফজি প্রিন্স ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আব্দুর রাজ্জাককে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে কয়েকশত বিএনপি নেতা-কর্মীর নামে মামলায় সহযোগিতা করেন। এই প্রিন্সও এখন স্বপন ফকিরের প্রধান সিপাহী হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এতে দলের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্বপন ফকির গত বছরের ৫ আগস্টের পর এলাকায় এসে তিনি রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। বিগত সরকারের ডামি নির্বাচনে স্বপন ফকির বিএনপির সদস্য হলেও আওয়ামী লীগের হয়ে গত তিনটি নির্বাচনে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার অভিযোগ রয়েছে।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা বিএনপির বিরাজমান চার গ্রুপের মধ্যে প্রতিটি গ্রুপ পাল্টাপাল্টি আলাদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ মিছিল করছে। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোবাইর আল মাহমুদ রিজভীর নেতৃত্বে, এবং লে. কর্নেল (অব.) আসাদুল ইসলাম আজাদের ‘কর্নেল আজাদ সমর্থক গোষ্ঠী’ ব্যানারে আনন্দ মিছিল করা হয়।
এতে মূল দল বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা অংশ নেন। কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য স্বপন ফকির গ্রুপও মিছিল করেন; তার সঙ্গে ছিলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাকির হোসেন সরকার ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিনসহ পৌর বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী। এসব বিভাজন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে বিরূপ প্রভাব তৈরি করেছে।
কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য স্বপন ফকিরের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় বিএনপি নেতাদের নিয়ে নানা অপপ্রচার শুরু করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, এত কিছুর পরেও যদি স্বপন ফকিরকে মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে এবারও বিএনপি’র ভরাডুবি হবে। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে যাবে।