মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী:
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীর উপর বহুলকাঙ্খিত কদম রসূল সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে বন্দরবাসীর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের স্বপ্নপূরণের যাত্রা শুরু হলো। ৩ ডিসেম্বর ২০২৫, বুধবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের জনবান্ধব প্রশাসক ড. আবু নছর মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ শীতলক্ষ্যার ৫ নম্বর খেয়া ঘাট সংলগ্ন এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ রায়হান কবির, সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোঃ নূর কুতুবুল আলম, এলজিডির নির্বাহী পরিচালক, সদর উপজেলা প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত রুবেলসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এলাকাবাসীর ব্যাপক উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি রূপ নেয় এক উৎসবমুখর পরিবেশে, যেখানে মানুষের মধ্যে বহু দিনের প্রত্যাশা ও স্বস্তির আবেগ বিরাজ করছিল।
কদম রসূল সেতুটি নির্মিত হলে নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর ঘাট ও বন্দর উপজেলার একরামপুর এলাকার মধ্যে স্থায়ী ও নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। বর্তমানে এই দুই এলাকার মানুষকে যাতায়াতে খেয়া নৌকার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা বর্ষাকাল, দুঘর্টনা বা জরুরি পরিস্থিতিতে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি করে। বিশেষ করে হাসপাতালগামী রোগী, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, শিল্পকারখানার শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের জন্য এই সেতুটি হবে জীবনমান উন্নয়নের এক বড় পদক্ষেপ। নির্মাণ শুরু হওয়ায় দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে এবং অনেকে এটিকে এলাকায় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যুগান্তকারী সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সেতুর পশ্চিম প্রান্তের সংযোগ সড়কের নকশা নিয়ে কিছু সংগঠন ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে পরিবর্তনের দাবি উঠেছিল, যা এলাকায় সামান্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে সেতুটি তার নির্ধারিত স্থানেই নির্মিত হবে এবং নকশা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, মূল নকশায় পরিবর্তন আনলে নদীর গতিপথ, আশপাশের আবাসিক এলাকা এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তই সর্বোত্তম। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে স্থানীয় মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসে এবং বিভ্রান্তিও দ্রুত কাটতে থাকে।
সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি হিসেবে ইতোমধ্যে মাটি পরীক্ষা, নদীর গভীরতা পরিমাপ এবং পিলার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকৌশলীরা প্রতিদিনই নদীর তলদেশে মাটি পরীক্ষা করে পাইলিংয়ের উপযোগিতা যাচাই করছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দ্রুতই পাইলিংয়ের কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এলজিডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাজ সঠিক গতিতে এগোলে নির্ধারিত সময়েই প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে।
বন্দরবাসীর কাছে এই সেতু শুধু একটি অবকাঠামো নয়; এটি তাদের দীর্ঘভোগান্তির সমাধান এবং উন্নয়নের নতুন দিগন্ত। প্রায় দশ লাখ মানুষের যাতায়াত, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে সেতুটি বদলে দেবে পুরো এলাকার চিত্র। বহু বছর ধরে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে সেতু বাস্তবায়ন ঝুলে থাকলেও এবার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে সেই স্বপ্ন। স্থানীয় এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা জীবনে অনেক প্রতিশ্রুতি শুনেছি, কিন্তু আজকের দিনটি সত্যি আলাদা। মনে হচ্ছে আমাদের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে।’
সব মিলিয়ে কদম রসূল সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সেতুটি নির্মিত হলে শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রায় আসবে আমূল পরিবর্তন, কমে যাবে সময় ও খরচ, আর বাড়বে জীবনমান। উন্নয়ন, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পাঞ্চল বিস্তারে এটি হবে নারায়ণগঞ্জের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।