মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী, ব্যুরো চিফ:
নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিক সমাজের অন্যতম সংগঠন নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে ২১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দাবির মধ্যে রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাংবাদিক হত্যা মামলাসহ সাগর-রুনি হত্যার দ্রুত বিচার, নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন, দশম ওয়েজ বোর্ড গঠন, চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের পুনর্বহাল এবং পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুরে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সাংবাদিকরা দুপুর ১২টার দিকে প্রেস ক্লাব চত্বরে সমবেত হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণের উদ্দেশ্যে একটি র্যালি বের করেন। র্যালিটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার প্রেস ক্লাবে ফিরে আসে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় ও সমবায় পতাকা উত্তোলন এবং উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভায় মিলিত হন সাংবাদিকরা। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা এস এম মাহফুজ হোসাইন। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লাভলী ইয়াসমিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিজভী আহম্মেদ সবুজ এবং থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুস সালাম।
আলোচনা সভায় বক্তারা সাংবাদিক হত্যার প্রেক্ষাপট বিশেষভাবে তুলে ধরেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হত্যা হওয়া সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি দম্পতির হত্যা মামলায় এখনও বিচার শেষ হয়নি। বক্তারা বলেন, “১৩ বছর ধরে সময় নেওয়া হয়েছে, তদন্তের নামে প্রহসন চলছে। একটি রাষ্ট্রে সাংবাদিকরা ন্যায়বিচার না পেলে সাধারণ মানুষ কিভাবে নিরাপদ থাকবে?” এছাড়াও মুকুল, দিপক, শিমুল, হুমায়ুন কবীর বাবুসহ বিভিন্ন সময় নিহত সাংবাদিকদের হত্যাকাণ্ডও এখনো বিচারহীন। বক্তারা বলেন, সাংবাদিক সমাজ এই দীর্ঘ বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
সমাবেশে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের দাবি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়। নবম ওয়েজ বোর্ড ঘোষণার পরও অধিকাংশ গণমাধ্যম মালিক তা বাস্তবায়ন করেননি। বক্তারা জানান, “মাঠে আমরা ঝুঁকি নিই, গুলি-লাঠির মুখোমুখি দাঁড়াই, কিন্তু মাস শেষে ন্যায্য বেতন পাই না। ওয়েজ বোর্ড কার্যকর হলে সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা ও জীবনমান উন্নত হবে। এছাড়া দ্রুত দশম ওয়েজ বোর্ড গঠনও অত্যন্ত জরুরি।” ডিজিটাল যুগে সংবাদপেশা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও সুবিধা ও সংরক্ষণ ততটা বৃদ্ধি পাচ্ছে না বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।
এছাড়া সমাবেশে সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অযৌক্তিকভাবে চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের পুনর্বহাল করার দাবিও উঠেছে। নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের এক সদস্য বলেন, “অনেক মিডিয়া হাউস রাজনৈতিক চাপ বা কাভারেজের কারণে সাংবাদিকদের বরখাস্ত করে। এটি শুধু শ্রম অধিকার লঙ্ঘন নয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও আঘাত।” বক্তারা আরও বলেন, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসনিক পদক্ষেপ জরুরি।
২১ দফার দাবিগুলো শুধুমাত্র সাংবাদিক সমাজের দাবি নয়, এটি গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইও বটে। বিক্ষোভ সমাবেশে নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক থেকে শুরু করে তরুণ রিপোর্টাররা একত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু সাউদ মাসুদ; সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাফুজুর রহমান; দি নিউ নেশন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এ আর ফররুখ আহমেদ খসরু; দৈনিক দিনকাল পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি এম আর কালাম, নাহিদ আজাদ; দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি মোশতাক আহমেদ; নিউজ টুয়েন্টিফোর টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি শরিফ সুমন; বাংলাদেশ বুলেটিনের সোনারগাঁ প্রতিনিধি উজ্জ্বল হোসেন মাসুম; দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি ও দৈনিক সোজাসাপটা পত্রিকার চিফ রিপোর্টার সাব্বির হোসেন; দৈনিক স্বাধীন সংবাদ পত্রিকা ও ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়ার জেলা ব্যুরো চিফ মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী; দৈনিক ইয়াদ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মাহাবুব মিয়া; দৈনিক পূর্বাভাস পত্রিকার যুগ্ম আহ্বায়ক সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি; দৈনিক দেশ পত্রিকার মোখলেছুর রহমান তোতা; বাংলাদেশের প্রতিদিনের রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম হানিফ; নয়া দিগন্ত পত্রিকার ফতুল্লার প্রতিনিধি নিয়াজ মোহাম্মদ মাসুম; মানব জমিনের ফতুল্লা প্রতিনিধি আবু সাঈদ পাটুয়ারী রাসেল, ইত্যাদি।
বক্তারা সাংবাদিক সমাজের ঐক্য ও সংহতির ওপর জোর দিয়ে বলেন, “আমরা আমাদের পেশাগত অধিকার রক্ষা করতে সচেতন, একসঙ্গে এবং সুসংগঠিতভাবে আন্দোলন চালাব। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, ন্যায্য বেতন, দ্রুত বিচার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ছাড়া গণমাধ্যম স্বাধীন হবে না।” তারা আরও উল্লেখ করেন যে, সাংবাদিক সমাজের এই আন্দোলন ভবিষ্যতের সাংবাদিক প্রজন্মকে সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমাবেশে বক্তারা নাগরিকদেরও সচেতন হতে আহ্বান জানান। তারা বলেন, “সাংবাদিকরা জনগণের চোখ ও কান। তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা মানে গণতন্ত্র রক্ষা করা।” আলোচনায় অংশ নেওয়া সাংবাদিকরা একমত পোষণ করেন, যে ২১ দফার বাস্তবায়ন শুধুমাত্র পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করবে না, এটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করবে।