প্রবাস চক্রবর্তী
বোয়ালখালীতে গত কয়েকদিনে পরিচিত অপরিচিত অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন গ্রুপে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন বাচ্চাকে টাইফয়েড এর টিকা দেবেন কি দেবেন না। ১২ ই অক্টোবর ২০২৫ হতে দেশব্যাপী শুরু হওয়া টাইফয়েড ক্যাম্পেইন এর ব্যাপার এ ছড়িয়ে পড়া নানা গুজব যাচাই বাছাই না করেই শেয়ার দিচ্ছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এতে সমস্যা যা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। আমাদের দেশের অর্থনীতি এমন যে এক শ্রেণি পেশার মানুষ এর জন্য টাকা কোন সমস্যা নয়। তারা সরকারি জিনিসে বিশ্বাস করেন না।সরকারি যে কোন কিছুতেই তারা ভরসা পান না। আবার বেশিরভাগ মানুষ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ফেলেন। সরকারিতে যদি সব মানসম্পন্ন আর ভালো জিনিস পাওয়া যেতো সেই আশায় তারা বুক বাঁধে। গুজব ছড়ালে এই শ্রেণির মানুষ খুব ক্ষতিগ্রস্ত হন।তারা ভালো উদ্যোগ হতে বঞ্চিত হন।
বাংলাদেশ সারা বিশ্বে টিকা প্রদান কর্মসূচিতে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। হাসপাতালের ডিজিজ বার্ডেন কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টিকাদান ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে। টিকাদান রোগ প্রতিরোধ এর অন্যতম একটা উপায়। শুধুমাত্র জনচেতনতা বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব নয়।বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক টিকা প্রদানের মাধ্যমে রোগ নির্মূলের বহু ইতিহাস আছে। প্রমাণ হিসেবে স্মল পক্স, পোলিও নির্মূলের ইতিহাস পড়ে দেখতে পারেন। তাছাড়া কোন রোগের টিকা বিনামূল্যে প্রদান করতে হলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তূকি দিতে হয়। সরকার যে কোন টিকা কেনার আগে চাহিদা নিরূপণ, প্রয়োজনীয়তা, রিস্ক বেনিফিট রেশিও সহ অনেক কিছু হিসাব করে যে কোন টিকা প্রদানের পজিটিভ নেগেটিভ দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এবার আসি টাইফয়েড এর কথায়। বিশ্বব্যাপী, টাইফয়েড একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য হুমকি, যা সালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয় এবং দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়ায় ।গ্লোবাল ডিজিজ বার্ডেন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২১ সালে প্রায় ৪,৭৮,০০০ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিল এবং এর ফলে ৮,০০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে প্রায় ৬৮% ছিল শিশু। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়ার মতো অঞ্চলে টাইফয়েড জ্বরের প্রবণতা রয়েছে । এ কারণেই পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ায় টাইফয়েড টিকা নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তান আর নেপালে ক্যাম্পেইন করে দেয়া হয়েছে এই টিকা। অন্যান্য উন্নত দেশে এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্তের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় বলে সেখানে এই টিকার প্রয়োজনীয়তা নাই।ঠিক যেমন মার্স কো ভি এর মতো রোগের টিকা আমাদের দেশে প্রয়োজন নাই।
টাইফয়েডের জটিলতা এত বেশি যে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যেককে সম্ভব হলে এই টিকা দিতো সরকার। কিন্তু বাজেটের সীমাবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এক ডোজ টাইফয়েড এর টিকা অন্তত নিশ্চিত করেছে সরকার। এই টিকাও কিন্তু ৫ বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দিবে।এরপর আরও সুরক্ষার জন্য বুস্টার ডোজ দিতে চাইলে কিনে মারতে হবে টিকাটি।সরকার আর সাপোর্ট দিতে পারবে না পরবর্তীতে।বর্তমান ক্যাম্পেইনে ৯ মাস হতে ১৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের টিকা দেয়া হচ্ছে। ১৩ ই নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত এ ক্যাম্পেইন চলবে।এরপর সামনের বছর হতে শুধুমাত্র ৯ মাস বয়সী শিশুদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে বিনামূল্যে এ টিকাটি প্রদান করা হবে। আপনি চাইলেও সরকার আপনাকে বিনামূল্যে এ টিকাটি আর দেবে না।
তাছাড়া বাজারে পাওয়া টাইফয়েড টিকাগুলো পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন যা তিন বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। সরকার যে টিকাগুলো কিনেছে সেগুলো কনজুগেট ভ্যাকসিন এবং এগুলো ৫ বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে। টিকাগুলো কোনভাবেই সরকার বিনামূল্যে পায়নি বা এগুলো কোন ট্রায়াল টিকা নয়। অনলাইনে আইসিডিডিআরবির গবেষণার উল্লেখ করে যে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা গুজব খাই বেশি।যাচাই বাছাই করতে আমাদের মন চায় না। অনেক শিক্ষিত মানুষও যাচাই বাছাই না করে টাইফয়েড এর টিকার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা চিন্তাও করতে পারছেন না কতজনের ক্ষতি করছেন তারা। আপনাদের প্রতি অনুরোধ দয়া করে একটু পড়াশোনা করুন। নিজের বিবেককে কাজে লাগান। আমাদের দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো খুব অবহেলিত। তাদেরকে কনফিউজড করবেন না। তাদের বাচ্চাদের সুরক্ষিত করতে দিন।
শুধুমাত্র পূর্বে টিকা দিয়ে এলার্জির ইতিহাস থাকলে, টিকা গ্রহণ এর দিন জ্বর থাকলে বা গর্ভবতী হলে টাইফয়েড টিকা দেয়া যাবে না। কোন প্রশ্ন থাকলে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে যেখানে টিকা দেয়া হচ্ছে সেখানে ডাক্তার এর পরামর্শ নিন। টাইফয়েড ক্যাম্পেইন একটি সুযোগ আপনার বাচ্চাকে বিনামূল্যে টাইফয়েড এর বিরুদ্ধে সুরক্ষিত করার।এ সুযোগ হেলায় হারাবেন না।
ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি
এমবিবিএস, এম এস সি( এপ্লায়েড এপিডেমিওলজি), অ্যাডভান্সড ফেলো ইন ফিল্ড এপিডেমিওলজি ( ইউ এস-সিডিসি),
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ,
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম ),
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।