ভিটেমাটি হারিয়ে আজ নিজ দেশে পরবাসী সম্পা আক্তার

স্টাফ রিপোর্টার:

৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতির পালাবদল বাংলাদেশে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। এই সহিংসতার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্তের একটি মাদারীপুরের সম্পা আক্তার।

“আমার নিজের বাড়িতে আমি পরবাসী”

রাজৈর উপজেলার বিশ্বস্তরদী গ্রামের কবিরাজপুরে জন্ম সম্পা আক্তারের। বাবার নাম জঙ্গি মিয়া, মা ফাতেমা হাওলাদার—যারা বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশে থেকেও আজ তিনি যেন আশ্রয়হীন এক ভিনদেশী।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেত্রী সম্পা আক্তার নিজেই জানালেন তার অসহায়ত্বের কথা—
“আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আমাদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আমার পরিবারকে ভয় দেখানো হয়। এখন আমরা বাড়িতে ফিরতে পারি না। এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে আছি। আমার ছোট মেয়েটা প্রতিদিন ভয়ে কাঁদে। রাতে ঘুম আসে না, শুধু আতঙ্ক কাজ করে।”

তার ভাষায় বোঝা যায়, একসময় রাজনৈতিক প্রভাবশালী হলেও আজ তিনি নিঃস্ব। সারা জীবনের সঞ্চয়ে তৈরি ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভাঙা সংসার, ভাঙা জীবন, সম্পা আক্তারের ব্যক্তিজীবনও কম বেদনাদায়ক নয়। স্বামী মো. মাহবুবুর রহমান থেকে বহু আগেই তালাকপ্রাপ্ত। সেই সংসারে জন্ম নেওয়া একমাত্র কন্যা, আরশ রহমান (৭ বছর), আজ তার একমাত্র সঙ্গী। মা-মেয়ে মিলে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ভেতরেই দিন কাটাচ্ছেন।

অন্যদিকে, পারিবারিক মূল শেকড়ও আজ ভেঙে ছড়িয়ে গেছে। সম্পার বাবা-মা এবং ভাই শাহরিয়ার অপু মিয়া থাকেন যুক্তরাজ্যে। বোন সাথী রহমানও রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে দুই সন্তানের একজনকে নানার কাছে পাঠিয়ে বাকি সন্তানকে নিয়ে দেশে দুঃসহ জীবন পার করছেন।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি, সম্পা আক্তারের অভিযোগ, এসব হামলা শুধু হঠাৎ ঘটে যাওয়া সহিংসতা নয়; বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, “আমরা কোনো অপরাধ করিনি। শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলাম, এটাই এখন আমাদের অপরাধ।”

একই সুরে কথা বললেন তার বোন সাথী রহমানও। তার মতে, ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ নিয়ে অনেকে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিচ্ছে।

ভাঙা ঘর, ভাঙা স্বপ্ন, সম্পা আক্তারের গল্প আসলে হাজারো রাজনৈতিক সমর্থকের গল্প। আন্দোলন-সংগ্রামে তারা একসময় সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। অথচ এখন তারা নিজের গ্রামেই ভিটেমাটি হারিয়ে শরণার্থী জীবনে ঠেলে দেওয়া হয়েছেন।

তার চোখে এখন শুধু প্রশ্ন—
“আমি কি আর কখনো আমার ঘরে ফিরতে পারব?”

সম্পা আক্তারের মতো অসংখ্য নারী-পুরুষ আজ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। রাজনৈতিক পরিবর্তনের যে জোয়ার ঢেউ আনে, সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ভেসে যাচ্ছে সাধারণ মানুষই। নিজ দেশে থেকেও তারা হয়ে যাচ্ছেন পরবাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *