স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
২০২৫ সালের জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, টিএসসি, শহীদ মিনার, হলপাড়া—সব জায়গায় তখন গর্জে উঠেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কণ্ঠস্বর। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে তা এক সময় রূপ নেয় সরাসরি সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে। আর সেই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন একঝাঁক সাহসী নারী, যাদের নেতৃত্বের অন্যতম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছাত্র ফেডারেশনের নেত্রী উমামা ফাতেমা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে উমামা ফাতেমা তুলে ধরেছেন আন্দোলনের পেছনের গল্প, মাঠে-ময়দানে নিজের অভিজ্ঞতা এবং নারী নেতৃত্বের গুরুত্ব।
“শেখ হাসিনার কথায় আমরা ফুঁসে উঠেছিলাম”
১৪ জুলাই, ২০২৫। বঙ্গভবন থেকে ফেরার পর বিকেলে শেখ হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের “রাজাকারের সন্তান” আখ্যা দেন। আর এই মন্তব্যেই যেন আগুনে ঘি পড়ে। উমামা বলেন, “আমরা চরমভাবে অপমানিত হয়েছিলাম। আমরা তো কেবল আমাদের যৌক্তিক দাবি নিয়েই মাঠে ছিলাম। সেই জায়গা থেকে এমন অপমান সহ্য করা অসম্ভব ছিল।”
সেই রাতেই মেয়েরা হল ছেড়ে রাজপথে নামে। স্লোগান ওঠে, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।”
প্রথম দিনগুলোর গল্প: “একটা দায়িত্ববোধ থেকেই মাঠে নামি”
উমামা জানান, “৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের করে। আমি তখন ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব ছিলাম। দায়িত্বের জায়গা থেকেই যুক্ত হই। এরপর ৯ জুন রাজু ভাস্কর্যে বড় জমায়েত হয় এবং আমরা মেয়েদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিই।”
পহেলা জুলাই থেকে আন্দোলন নতুন গতি পায়। তখন থেকে হলভিত্তিক নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাঠে নামেন তিনি।
হলপাড়ার প্রতিরোধ: “ছাত্রলীগ আমাদের টার্গেট করে মারছিল”
“ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব ছিল,” জানান উমামা। “তারা গেট আটকে দিত যাতে কেউ বের হতে না পারে। তখন আমরা মেয়েরা গিয়ে তাদের বের করে নিয়ে আসতাম। আমাদের দিকে পাথর, লাঠি এমনকি জুতা ছোড়া হতো।”
উল্লেখযোগ্যভাবে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে প্রথম কোটা আন্দোলনের সময় সুফিয়া কামাল হলের মেয়েরা ছাত্রলীগ নেত্রী এশাকে জুতার মালা পরিয়ে বের করে দিয়েছিল। ফলে পরের বার আন্দোলনে হলটি ছিল সম্পূর্ণ ছাত্রলীগমুক্ত।
ভয়ঙ্কর সেই ১৫ জুলাই
“১৪ তারিখ শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর ১৫ জুলাই ক্যাম্পাসে ভীষণ উত্তেজনা দেখা দেয়,” বলেন উমামা। “সেদিন রাজু ভাস্কর্যে আমরা সমাবেশ ডাকি। ছাত্রলীগও একই জায়গায় প্রোগ্রাম নেয়। হলে ঢুকতে গেলে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর চড়াও হয়।”
তিনি আরও বলেন, “ছাত্রলীগ সেদিন সরাসরি মেয়েদেরকে টার্গেট করে হামলা চালায়। এক মেয়েকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার ছবি ভাইরাল হয়, যা আন্দোলনের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।”
“হল ছাড়ব না, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই ছিলাম”
১৫ জুলাইয়ের হামলার পর আন্দোলনকারীদের বড় একটা অংশ হল ত্যাগ করে। কিন্তু উমামা জানান, “মেয়েরা তখনও হলেই ছিল। ১৭ জুলাই দুপুরেও আমরা গুনে দেখি দেড়শর মতো মেয়ে ছিল যাঁরা হল ছাড়েননি।”
কিন্তু প্রশাসনের চাপে অবশেষে রাত আটটার পর তারা হল ছাড়তে বাধ্য হন। “আমার হাউজ টিউটর বলছিলেন উপর মহল থেকে ফোন এসেছে। তখন আর উপায় ছিল না।”
১৬ জুলাই রাত: “ছাত্রলীগকে হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি”
১৬ জুলাই রাতে রোকেয়া হল থেকে ছাত্রলীগ সভাপতি আতিকাকে বের করে দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য হলে ছাত্রলীগ নেতাদের হলছাড়া করা হয়। “সেই রাতেই প্রথম পাঁচটি মেয়েদের হল ছাত্রলীগমুক্ত হয়,” বলেন উমামা।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সময়ে তথ্য ছড়ানোই ছিল প্রধান যুদ্ধ
ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় উমামা মোবাইল খোলা রাখতেন, যেন কেউ যোগাযোগ করতে পারে। “তখন পত্রিকাই ছিল একমাত্র মাধ্যম। সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতাম, যাতে সবাই জানে আমরা মাঠে আছি।”
পারিবারিক চাপ ও রাজনৈতিক হুমকি
“পরিবার আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়, বুঝাতে থাকে আন্দোলন থেকে সরে যেতে,” বলেন উমামা। “কিন্তু আমি জানতাম, এটাই আমার লড়াইয়ের সময়। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল হলেও সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।”
তিনি জানান, এনএসআই, ডিবি থেকে ফোন আসতো। একজন সংসদ সদস্য পর্যন্ত ফোন করে বোঝাতে চেয়েছিলেন। এমনকি গ্রামে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়েছে বলে খবর পান তিনি।
“২৮ জুলাইয়ের পরেই আসল আন্দোলনের রূপ দেখা যায়”
“প্রথমদিকে নয় দফা দাবি থাকলেও এরপর তা এক দফায় এসে দাঁড়ায়—সরকার পতন,” বলেন উমামা। “আমি মনে করি, এই দাবি ছিল জনতার—একেবারেই অর্গানিক। শেখ হাসিনা অথবা জনগণ—এই দ্বৈরথে জনগণ বেছে নেয় বিদ্রোহ।”
৪ ও ৫ আগস্ট: “আমি রাস্তায় লাশ দেখেছি”
“৪ আগস্ট রাস্তায় রক্তাক্ত শাহরিয়ার নাফিসকে রিকশায় নিতে দেখেছি। সেদিনই বুঝি সবকিছু বদলে গেছে,” বলেন উমামা।
“৫ আগস্ট সেনাপ্রধান যখন ভাষণ দিলেন, তখন আমরা নিশ্চিত হই—পরিবর্তনের সূচনা হয়ে গেছে।”
নারীদের অবদান: “প্রথম আঘাতটাই নারীরা দেয়”
“রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ নেত্রীকে বের করে দেওয়ার মাধ্যমে নারীরাই প্রথম আঘাত দেয়,” বলেন উমামা। “তারা শুধু উপস্থিত ছিল না, লিড করেছে। মেয়েরা ভাইদের কফিন কাঁধে নিয়েছে। এগুলো কেবল ঘটনা নয়, বিপ্লবের ভিত্তি।”
তিনি বলেন, “এই আন্দোলন শুধু ছেলেদের নয়, নারীরাও সমান অংশীদার। বিদ্রোহী নারীরাই এ আন্দোলনকে বিপ্লবে পরিণত করেছে।”