প্রতিবেদক- ব্যুরো চিফ মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী
সরকারি নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে, ফলে সৃষ্টি হয়েছে চরম ভোগান্তি।
হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা শয্যাসংকট। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন সরাসরি মেঝেতে।
শহরের মণ্ডলপাড়ার নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে গেলে চোখে পড়ে এক করুণ চিত্র। তৃতীয় তলার মেডিসিন ও ডেঙ্গু ওয়ার্ডে বেডের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ রোগী ভর্তি। করিডর, মেঝে, এমনকি ওয়ার্ডের দরজার সামনেও রোগীদের শুয়ে থাকতে দেখা যায়। গরমে নাকাল রোগীরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন ওষুধের অপেক্ষায়।
হাসপাতালটির রেকর্ড অনুযায়ী, আগস্ট মাসে ভর্তি হয়েছিলেন ১১৬ জন ডেঙ্গু রোগী। সেপ্টেম্বর মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২৯ জনে, আর অক্টোবরের প্রথম আটদিনেই ভর্তি হয়েছেন আরও ২৮ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন মোট ৫৪৩ জন। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই এখানে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ ডেঙ্গু পরীক্ষা করেছেন।
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে শহরের খানপুর ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালেও। জুন মাসে সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন ২০ জন, জুলাইয়ে ৮৮ জন, আগস্টে ১৬৬ জন, সেপ্টেম্বরে ২৭০ জন এবং অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই আরও ৫০ জন। দুই হাসপাতালেই প্রতিদিন বাড়ছে নতুন রোগীর সংখ্যা, কমছে না একটুও। অনেক রোগীকে এখন ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। শহরের পাড়া-মহল্লা থেকে প্রতিদিনই ডেঙ্গু -আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর আসছে।
মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন এক রোগীর স্বজন বলেন, “শয্যা না থাকায় মেঝেতে কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছি। মশার যন্ত্রণা তো আছেই, তার ওপর ফ্যান নেই গরমে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তবুও কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।” বিশেষজ্ঞদের মতে, নারায়ণগঞ্জের বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেবল রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, এটি নাগরিক অব্যবস্থাপনারও প্রতিফলন। থেমে থেমে বৃষ্টি, – নোংরা ড্রেন, আবর্জনার স্তূপ, আর নাগরিক অসচেতনতা সব মিলিয়ে ডেঙ্গু এখন প্রায় মহামারির রূপ নিয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সীমিত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে জটিল রোগীদের ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের কোনো সরকারি হাসপাতালে প্লাটিলেট কাউন্ট বা সেপারেশন মেশিন নেই। ফলে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা ডিএনসিসি হাসপাতালে রেফার্ড করতে হচ্ছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, শহরের দুই সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ মেশিন থাকলেও তা ব্যবহারের মতো ডাক্তার নেই। ফলে জটিল রোগীরা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. জহিরুল ইসলাম বলেন, “রোগীর চাপ এতটাই বেশি যে, বেডে জায়গা না থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে মেঝেতে চিকিৎসা দিচ্ছি। হাসপাতালের সক্ষমতা সীমিত হলেও কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না। সাধ্যমতো চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি।” অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “আমরা নিয়মিত মশা নিধনের ওষুধ ছিটাচ্ছি। কিন্তু মশার জিনগত পরিবর্তনের কারণে ওষুধে কাজ হচ্ছে না। এতে করে নতুন ধরণের ডেঙ্গু বিস্তারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।”
জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মুহম্মদ মুশিউর রহমান বলেন, “প্রতিদিন সরকারি দুই হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে এখনো পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলা যাবে না। মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। সচেতনতা বাড়ানো ও মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।”
তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র বলছে অন্য কথা। হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে থাকা অসুস্থ মানুষ, ব্যস্ত ডাক্তার-নার্সদের হিমশিম খাওয়া, ওষুধের অভাব আর সরকারি হিসাবের ঘাটতি সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জের ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন যেন এক অদৃশ্য আতঙ্কের নাম।