মোহাম্মদ হোসেন হ্যাপী, ব্যুরো চিফ:
প্রাচীন বাংলার রাজধানী খ্যাত ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ের ১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৩ সোনারগাঁ আসনের রাজনীতি নতুন সমীকরণের মুখোমুখি হয়েছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন এই আসনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১০টি ওয়ার্ড (সিদ্ধিরগঞ্জ থানা) যুক্ত করার পর এখানকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেছে।
এ আসনের সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির সাতজন প্রার্থী মনোনয়নের জন্য মাঠে নেমেছেন। বিএনপিতে প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলো একক প্রার্থী নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এছাড়াও এনসিপি ও অন্যান্য দলের একক প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সারাদেশের ন্যায় সোনারগাঁয়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের হাওয়া চলে আসে। সেই হাওয়ায় আওয়ামী লীগ মাঠ থেকে আউট হয়ে যাওয়ায় বিএনপির সাতজন প্রার্থী পুরো নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। তা দেখে মনে হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপিই এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
বিএনপির মনোনয়নপ্রার্থীরা
মনোনয়ন যুদ্ধে যারা মাঠে নেমেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন:
-
সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম
-
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য মুহাম্মাদ গিয়াস উদ্দিন
-
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির আহবায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ
-
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সোনারগাঁ থানা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান
-
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এস এম ওয়ালিউর রহমান আপেল
-
কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সভাপতি অধ্যাপক ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বরুন
-
উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আল মুজাহিদ মল্লিক
এই প্রার্থীরা নানাভাবে নির্বাচনী এলাকায় সক্রিয়। তারা মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেন, উঠান বৈঠক করছেন, লিফলেট বিতরণ করছেন এবং সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছেন।
অন্যান্য দলের একক প্রার্থী
এ আসনে অন্যান্য দলের একক প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন।
-
জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য অধ্যক্ষ ড. ইকবাল হুসাইন ভূঁইয়া
-
খেলাফত মজলিশের সোনারগাঁ উপজেলা শাখার সভাপতি মাওলানা মো. সিরাজুল ইসলাম
-
ইসলামী আন্দোলনের ফারুক আহমেদ মুন্সি
-
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জাতীয় যুবশক্তির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক তুহিন মাহমুদ
এই প্রার্থীরা এককভাবে নির্বাচন করে যাচ্ছেন, ফলে তাদের প্রচারণা তুলনামূলকভাবে সংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত।
আসনের রাজনৈতিক ইতিহাস
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির ঘাটিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এখানে একটানা সংসদ সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম। তাই এই আসনকে জেলা বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৫,৮৩,৯৫২ জন। এর মধ্যে সোনারগাঁ উপজেলায় ৩,৬৩,৩৭৫ জন এবং সিদ্ধিরগঞ্জে ২,২০,৫৭৭ জন ভোটার রয়েছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা যুক্ত ছিল। তবে পরবর্তী দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কায়সার হাসনাত পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আবারো সিদ্ধিরগঞ্জ থানাকে সোনারগাঁর সঙ্গে যুক্ত করে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন করা হয়েছে।
মনোনয়ন যুদ্ধ ও ভেতরের দ্বন্দ্ব
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে একটি অংশ মনে করেন, ৫ আগস্টের আগে সংসদ সদস্য প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের ইমেজ ভালো ছিল। তবে ওই সময় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, মেঘনা নদীর নৌযান ও মেঘনা টোল প্লাজা দখলের ঘটনায় তার অবস্থান কিছুটা দুর্বল হয়েছে। এ কারণে তিনি মনোনয়ন দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছেন।
অন্যদিকে মুহাম্মাদ গিয়াস উদ্দিন একবার নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন চাইলেও আবার নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়ন চান বলে মন্তব্য করেছেন। এতে তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। সোনারগাঁয়ের আজহারুল ইসলাম মান্নান ও গিয়াস উদ্দিনের সমর্থকরা মনোনয়ন নিয়ে মাঠে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন।
অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেন, “আমি নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে প্রার্থী হবো। মনোনয়ন চাইবো। নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদিনই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে কাজ করছি। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সঙ্গে আমার পূর্বের সংযোগ থাকলেও সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জে আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কার্যক্রম রয়েছে, তাই এখানে নির্বাচন করা আমার জন্য কঠিন হবে না।”
প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি
অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম: “আমি এমপি থাকাকালীন সময়ে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। যদি আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, সোনারগাঁয়ের অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজগুলো সম্পন্ন করবো।”
মুহাম্মাদ গিয়াস উদ্দিন: “আমি চাই সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে। মনোনয়ন পেলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় এ এলাকার উন্নয়ন কাজ করবো।”
আজহারুল ইসলাম মান্নান: “দলের দুর্দিনে অসংখ্য মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। দল আমাকে মূল্যায়ন করলে জনগণের সুখ দুঃখের সাথী হতে চাই।”
ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ: “ছাত্রাবস্থা থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সোনারগাঁবাসী আমাকে ভালোবাসেন। আশা করি দল আমাকে মনোনয়ন দিলে ধানের শীষকে জয়ী করে দলকে এর প্রতিদান দেব।”
আল মুজাহিদ মল্লিক: “আমি শিক্ষার, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করবো। নির্বাচনী এলাকায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ আনার চেষ্টা করবো।”
এস এম ওয়ালিউর রহমান আপেল: “দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, সোনারগাঁকে আধুনিক, শিক্ষিত ও কর্মসংস্থানের শহর হিসেবে গড়ে তুলবো। নদী ও খাল দখল মুক্ত করা হবে।”
ড. ইকবাল হুসাইন ভূঁইয়া (জামায়াতে ইসলাম): “সোনারগাঁয়ের সব এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে আমি স্বচ্ছ এবং সক্রিয়।”
তুহিন মাহমুদ (এনসিপি): “সোনারগাঁবাসী পরিবর্তন ও অগ্রগতির পথে এগোতে চায়। আমরা সাধারণ মানুষের মতামত শুনেছি। তরুণ সমাজের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা এবং আগ্রহ রয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলোর প্রার্থী থাকলেও, বর্তমানে বিএনপিই শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আসনের ভোটারদের মধ্যে বিএনপির পুরনো সমর্থক সংখ্যাই বেশি। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির নেতারা এখানে সংগঠন এবং সমর্থন গড়ে তুলেছেন।
সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের একক প্রার্থী হলেও বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে আজহারুল ইসলাম মান্নান ও মুহাম্মাদ গিয়াস উদ্দিনের সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থানে থাকায় ভোটারদের মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিভিন্ন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছেন। উঠান বৈঠক, লিফলেট বিতরণ এবং দলের রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর মনোযোগ তাদের মূল কৌশল। বিএনপি প্রার্থীরা জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালা ও রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের ৩১ দফা প্রচারণার মাধ্যমে ভোটারদের কাছে নিজেদের কার্যক্রম তুলে ধরছেন।
সোনারগাঁয়ের ভোটাররা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয় উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, নদী-খাল সংরক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন। প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে এই স্থানীয় বিষয়গুলো ভোটারের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলবে।
উপসংহার
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের রাজনীতি এখন একেবারে নতুন সমীকরণের মুখোমুখি। বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিএনপি ছাড়া অন্যান্য দলের একক প্রার্থীরা এবং স্থানীয় ভোটারদের প্রত্যাশা মিলিতভাবে নির্বাচনী পরিস্থিতিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ইতিহাস এবং বাস্তবিক রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী, বিএনপি শক্ত অবস্থানে থাকলেও আসনটি সহজ নয়। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের ফলাফল রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক হতে পারে।
ভোটারদের দৃষ্টি, প্রার্থীদের সংগঠন ও প্রচারণা এবং স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির প্রভাব মিলিতভাবে এই আসনের রাজনৈতিক সমীকরণ নির্ধারণ করবে। নির্বাচনী ময়দানে যেভাবেই হোক, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের এই রাজনীতির নতুন অধ্যায় বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতির জন্য একটি নজরকাড়া দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।