স্টাফ রিপোর্টার:
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর তিন উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী—বর্তমান উপ-প্রধান প্রকৌশলী এ. এইচ. এম. ফরহাদুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী (পিআরএলরত) মো. জহিরুল ইসলাম, এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (অবসরপ্রাপ্ত) আবু বকর সিদ্দিক—এর বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের একটি গুরুতর ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ পুনরায় তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অভিযোগকারী মো: মিরাজ ভূঁইয়া, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অভিযোগ দায়েরের প্রেক্ষিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, এই তিন কর্মকর্তা কেবল ফৌজদারি মামলার অভিযুক্তই নন, বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত অবৈধ ঘোষিত ‘সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন’ (ট্রুথ কমিশন)-এ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতির স্বীকারোক্তি দিয়ে অনুকম্পা সনদ নিয়েছিলেন। এই আত্মস্বীকৃত অপরাধের পরও হাইকোর্টের পৃথক রীট আদেশের সুযোগে তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল এবং একের পর এক পদোন্নতি দেওয়া হয়।
মূল অভিযোগ: ঘুষ গ্রহণ ও মামলা:
বিআইডব্লিউটিএ’র আরিচা-রাজশাহী-গোদাগাড়ী-ভোলাহাট নদী পথ খনন প্রকল্পে ড্রেজিং কাজের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে এই তিন কর্মকর্তা বেসিক ড্রেজিং কোম্পানীর সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) ও সচিব গাজী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন-এর কাছ থেকে দি-ট্রাষ্ট ব্যাংক লি.-এর পে-অর্ডারের মাধ্যমে সর্বমোট ১৫,৬৮,৭০৬/- (পনেরো লক্ষ আটষট্টি হাজার সাত শত ছয়) টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এই অভিযোগে বেসিক ড্রেজিং কোম্পানীর সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক গাজী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), ঢাকার মতিঝিল থানার মামলা নং-১৭, তারিখ: ০৪/০৬/২০০৮, ধারা: দন্ডবিধি ১৬১, ১৬৫(ক) এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা দায়ের করেন। পরবর্তীতে মামলাটি তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
হাইকোর্টের রায়, বিভাগীয় মামলার পরিসমাপ্তি ও পদোন্নতি:
ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এবং পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ তিন কর্মকর্তা—এ. এইচ. এম. ফরহাদুজ্জামান (তৎকালীন সহকারী প্রকৌশলী), মো. জহিরুল ইসলাম (তৎকালীন উপ-সহকারী প্রকৌশলী), এবং আবু বকর সিদ্দিক (তৎকালীন উপ-সহকারী প্রকৌশলী)—কে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে এবং বিভাগীয় মামলা রুজু করে।
তবে, এই কর্মকর্তারা সাময়িক বরখাস্তের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে পৃথক রীট পিটিশন দায়ের করেন:
এ. এইচ. এম. ফরহাদুজ্জামান: রীট পিটিশন নং-৮৩৮১/২০০৯, মো. জহিরুল ইসলাম: রীট পিটিশন নং-১১৫২/২০১০ এবং আবু বকর সিদ্দিক: রীট পিটিশন নং-৪৭৫/২০১০।
হাইকোর্ট এসব রীট পিটিশনের প্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলাগুলোকে ‘আইনত অকার্যকর’ ঘোষণা করে কর্মকর্তাদের সকল সুবিধাদিসহ চাকরিতে বহালের রায় প্রদান করেন। হাইকোর্টের এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ আইন উপদেষ্টার মতামত সাপেক্ষে তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ ও বিভাগীয় অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় এবং পরবর্তীতে তাদের একাধিকবার পদোন্নতি প্রদান করে:
এ. এইচ. এম. ফরহাদুজ্জামানকে দপ্তর আদেশ নং-২৩৫৩/২০১৭, তাং: ১২/১২/২০১৭ মূলে উপ-প্রধান প্রকৌশলী | মো. জহিরুল ইসলামকে দপ্তর আদেশ নং-৪০২/২০১৮, তাং: ০৭/০৩/২০১৮ মূলে নির্বাহী প্রকৌশলী (পিআরএলরত) এবং আবু বকর সিদ্দিককে দপ্তর আদেশ নং-৪০২/২০১৮, তাং: ০৭/০৩/২০১৮ মূলে নির্বাহী প্রকৌশলী (অবসরপ্রাপ্ত) পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
ট্রুথ কমিশনের অবৈধতা ও দুদকের নতুন নির্দেশনা:
এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হলো অভিযুক্তদের ট্রুথ কমিশন-এ আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এই কর্মকর্তারা ট্রুথ কমিশনে হাজির হয়ে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে স্বহস্তে লিখিত আবেদন স্বাক্ষর করে শপথপূর্বক দুর্নীতি করার স্বীকারোক্তি প্রদান করেন এবং অনুকম্পা সনদ পান।
তবে, ২০১১ সালের ১৬ মে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত ‘স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অধ্যাদেশ-২০০৮’ এবং এর অধীনে দেওয়া ট্রুথ কমিশনের সকল কার্যকলাপ ও অনুকম্পা সনদকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে বাতিল করে দেন (মামলা: Manjur Ahmed Bhuiyan and others v. Adilur Rahman and others)।
আপীল বিভাগের এই রায়ের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার সচিব ড. মো: শামসুল আরেফিন স্বাক্ষরিত স্মারক নং: দুদক/অনু: ও তদন্ত-৩/সি-১৮৮/২০০৯/ঢাকা মেট্রো/২৭৯৪৩(৫০), তারিখ: ১২/০৯/২০১৮ মূলে স্পষ্ট নির্দেশনা জারি করেন:
> “স্বপ্রনোদিত অথ্য প্রদাশ অধ্যাদেশ, ২০০৮… মাননীয় আপীল বিভাগ অধ্যাদেশটি বাতিল ঘোষণা করেছে। …এর ফলে, শুধুমাত্র Truth and Accountable Commission কর্তৃক অভিযুক্তের অপরাধ মার্জনা করা হলেও তাদেরকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেয়ার কোন সুযোগ নেই।”
>
দুদকের এই নির্দেশনা অনুযায়ী, ট্রুথ কমিশন কর্তৃক অনুকম্পা পাওয়া আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুনরায় উদ্যোগী হয়েছে দুদক।
পুনঃতদন্তের আইনি ভিত্তি ও যৌক্তিকতা:
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দায়ের করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. মো: আতিকুল ইসলামকে আহবায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। অভিযোগকারী মো: মিরাজ ভূঁইয়া ইতোমধ্যে গত ১৯/১১/২০২৫ তারিখে শুনানিতে অংশ নিয়েছেন।
অভিযোগকারী তার আবেদনে নিম্নলিখিত আইনি রেফারেন্স ও যুক্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুনরায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন:
বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলার পৃথকীকরণ:
হাইকোর্টের আদেশে কেবল বিভাগীয় মামলা আইনত অকার্যকর ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), ঢাকার মতিঝিল থানার মামলা নং-১৭, তারিখ: ০৪/০৬/২০০৮, ধারা: দন্ডবিধি ১৬১, ১৬৫(ক) এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এখনও তার নিজস্ব গতিতে বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলতে পারে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী (এবং ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের নজির State of Rajasthan vs. B.K. Meena) বিভাগীয় কার্যক্রম ও ফৌজদারি মামলা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
আত্মস্বীকৃত অপরাধ: অভিযুক্তরা স্বেচ্ছায় ট্রুথ কমিশনে ঘুষ গ্রহণের কথা স্বীকার করেছেন, যা তাদের অপরাধ প্রমাণের অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তি। উচ্চ আদালতের রায়ে ট্রুথ কমিশন অবৈধ হওয়ায়, এই আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি হওয়া আবশ্যক।
সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানা: আপীল বিভাগ কর্তৃক ট্রুথ কমিশন বাতিল হওয়ার পর এর অধীনে নেওয়া দায়মুক্তি বৈধ নয়। তাই, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের রীট আদেশের রেফারেন্স দিয়ে ফৌজদারি দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তা আইনত ভিত্তিহীন।
জনস্বার্থে এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুদকের মাধ্যমে ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতির মামলাগুলো সচল করা এবং মূল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), ঢাকার মতিঝিল থানার মামলা নং-১৭, তারিখ: ০৪/০৬/২০০৮, ধারা: দন্ডবিধি ১৬১, ১৬৫(ক) এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এর বর্তমান অবস্থা যাচাই করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের মোবক অধিশাখার উপসচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব পুলক কান্তি চক্রবর্তীর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রীপরিষদ হতে প্রাপ্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ মন্ত্রনালয়ের যুগ্মসচিব ড. মো: আতিকুল ইসলাম মহোদয়ের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষ হলে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
অভিযুক্ত ৩ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে তাদের নিকট জানতে চাইলে তারা এসব বিষয়ে কোন বক্তব্য প্রদান করতে রাজি হননি।