চট্টগ্রামে জনতা ব্যাংক সিবিএ ও শ্রমিক লীগের নেতা আফসারের দাপট, নিয়োগ, বদলি ও অনুষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজি

স্টাফ রিপোর্টার : 

 

আওয়ামী লীগের সময়ে নানা রকম অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে জনতা ব্যাংক গণতান্ত্রিক কর্মচারি ইউনিয়নের (সিবিএ) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল আফসারের বিরুদ্ধে। সংগঠনটির ব্যানারে ২০১৭ সাল থেকে গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচি পালন করেছেন এই সিবিএ নেতা। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এর বাইরে কর্মচারিদের বদলি, অস্থায়ী নিয়োগ ও হাউজ বিল্ডিং লোন পাস করানোর মাধ্যমে গত ৭ বছরে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানের পর তাকে ‘চট্টগ্রাম সি’ জোনে বদলি করা হয়। তবে জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় সিবিএ নেতার তদবিরে গত এক মাসেও সেই আদেশ কার্যকর হচ্ছে না। এ নিয়ে চট্টগ্রামের জনতা ব্যাংক কর্মচারিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৮ সালে গোডাউন কিপার হিসেবে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরিতে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ নুরুল আফসার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পরই জনতা ব্যাংক গণতান্ত্রিক কর্মচারি ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন সদস্যকে স্থায়ীকরণ করা হয়। সেই সময়ে নুরুল আফসারকেও স্থায়ী করা হয়েছিল। লবিং—তদবিরের মাধ্যমে ২০১৭ সালে সংগঠনটির বিভাগীয় কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন তিনি। এরপর থেকে সংগঠনের ব্যানারে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি পালন করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবসায়িদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে সংগঠনের কার্যালয়ে ১৫ আগস্ট, শেখ মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ হাসিনার জন্ম বার্ষিকী পালন করা হতো। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে গত ৭ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। এরমধ্যে কেবল মুজিব বর্ষ উদযাপনের নামেই হাতিয়ে নেন আট লাখ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন কর্মচারিদের সুবিধা মতো স্থানে বদলি করাতেন সিবিএ নেতা নুরুল আফসার। এজন্য ৪০—৫০ হাজার টাকা করে দিতে হতো। অস্থায়ী নিয়োগের জন্য নিতেন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা করে। কর্মচারিদের হাউজ বিল্ডিং লোন পাস করানোর জন্য প্রতি জন থেকে নিতেন অন্তত ৫০ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে এসব খাতে আরও ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। আর এসবের প্রতিবাদ করলেই নিজ সংগঠনের অনেককে চট্টগ্রাম থেকে দূরের জেলায় বদলি করানো হতো। এ কারণে অনেকেই নিরবে সবকিছু সহ্য করে গেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, ফেনী থেকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পর্যন্ত জনতা ব্যাংক কর্মচারিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন নুরুল আফসার। তার হুমকীতে তটস্থ থাকতেন খোদ ব্রাঞ্চ ম্যানেজাররাও। তার কথা না রাখলে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারদেরও বদলি করাতেন তিনি। ২০২২ সালে নিজের ছেলেকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করেন জনতা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার তৎকালীন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে। পরবর্তীতে তার ছেলে আনাসুল ইসলাম আনাসকে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়। এজন্য আনাসকে দৈনিক এক হাজার টাকা বেতন ধার্য করা হয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

নুরুল আফসারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে একই কমিটির সহ সভাপতি সরোয়ার উদ্দিন বলেন, ‘শেখ মুজিবের শাহাদাত বার্ষিকীসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নুরুল আফসার। কেবল মুজিব বর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে আট লাখ টাকা উঠানো হয়। কিন্তু করোনার কারণে মুজিব বর্ষ উদযাপন না হওয়ায় সেই টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তার (নুরুল আফসার) লোনের কিস্তি কেটে ৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। কিন্তু তিনি ২৪ হাজার টাকা ভাড়ায় বাসায় থাকতেন। সংগঠন থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থে গ্রামের বাড়িতে নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করায় আমাকে চট্টগ্রাম থেকে মাদারীপুর বদলি করানো হয়েছিল।’

একই কথা বলেছেন সাবেক সিবিএ নেতা কুতুব উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মুজিব বর্ষ উদযাপনের টাকা সংগ্রহ করতে আমি নিজেও গিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে অনুষ্ঠান আয়োজন না হওয়ায় সেই টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে আমাকে জামালপুর বদলি করা হয়েছিল।’
কার্যকরী সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, ‘বদলি ও অস্থায়ী নিয়োগ ছাড়াও নুরুল আফসারের সবচেয়ে বড় একটি আয়ের উৎস ছিল কর্মচারিদের হাউজ বিল্ডিং লোন পাস করিয়ে দেয়া। প্রতিটি পাস করানোর জন্য কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা নিতেন নুরুল আফসার। ইসহাক নামে এক দারোয়ানের কাছ থেকেও প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।’

মোহাম্মদ নুরুল আফসার জনতা ব্যাংক পিএলসি আগ্রাবাদ শাখায় এওজি—১ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। গত ১৭ অক্টোবর জনতা ব্যাংক পিএলসির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোস্তফা কামাল স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে চট্টগ্রাম—সি জোনে বদলি করা হয়। ২০ অক্টোবরের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের কথা থাকলেও এখনো তিনি পুর্বের কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংক পিএলসি আগ্রাবাদ শাখার ডিজিএম মো. ফজলুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেন। তবে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে আনসুল ইসলাম আনাসকে নিয়োগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পূর্ববর্তী কর্মকর্তা কাজের প্রয়োজনে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে আনাসকে নিয়োগ দিয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংক গণতান্ত্রিক কর্মচারি ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল আফসার বলেন, ‘আমরা সরকারি কর্মচারি। যখন যেই সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করি। তবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দিবসের নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ সত্য নয়। এমনটি যদি হতো বর্তমান সিবিএ নেতারা আমার বদলির জন্য তদবির করতো না। আমাকে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় নেতা জিএমকে অনুরোধ করেছেন। বর্তমানে আমি জাতীয়তাবাদী কর্মচারি ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করছি।’
জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী কর্মচারি ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী পন্থি সিবিএ নেতারা ১৭ বছর আমাকে চট্টগ্রামে বাইরে রেখেছে। বর্তমানে নুরুল আফসারকে সাধারণ সম্পাদক দিতে চাচ্ছে। কিন্তু তাকে নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। বিষয়টি আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছি।’

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী কর্মচারি ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নুরুল আফসারকে বদলি না করতে জিএমকে অনুরোধ করেছি। কারণ বদলিজনিত বা ব্যক্তিগত সুযোগ—সুবিধার কারণে অনেক বিএনপি সমর্থক আওয়ামী লীগের সময়ে তাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এখন তারাই দল বেধে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন। আমরা এগুলো যাচাই—বাছাই করছি। কেউ যদি কোন অনিয়ম—দুর্নীতি করে থাকে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। সেই দায় সংগঠন নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *