নওগাঁ প্রতিনিধি:
নওগাঁর রাণীনগরে ইউনিয়ন যুবলীগের এক নেতাকে নতুন করে বিস্ফোরক ও অস্ত্র মামলার ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে।
সেই সঙ্গে মামলা রেকর্ড হওয়ার আগেই তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে কৌশল হিসেবে অন্য দুইজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে যুবলীগের ওই নেতাকে। পরবর্তীতে দেখিয়ে দেওয়া দুজনের মধ্যে সালাম নামের একজন টাকা দাবি করে বসে সেই যুবলীগ নেতার কাছে।
অভিযোগ ওঠা বিএনপি নেতার নাম সানোয়ার হোসেন। তিনি রাণীনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে মনোনিত আছেন। যাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন তারা হলেন সালাম ও সাজ্জাদ নামে বিএনপির দুই সমর্থক।
অপরদিকে যার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে তার নাম পলক। তিনি উপজেলার সদর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক বলে দাবি করেন।
তিনটি কল রেকর্ডে জানা গেছে, সানোয়ার হোসেন নামের ওই নেতা পলককে বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র মামলার তালিকা হয়েছে জানায়। এরপর পলক উত্তোরণের উপায় জানতে চাইলে সালাম ও সাজ্জাদ নামের দুইজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। কথামতো পলক সাজ্জাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি সালাম নামের আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সেই অনুযায়ী সালাম প্রথমে ৫০ হাজার টাকা পলকের কাছে দাবি করে।
পরে ৩০ হাজার টাকা দিতে বলে বিকাশে। এমনকি সময় বেঁধে দেওয়া হয় পরের দিন দুপুরের মধ্যে। অন্যথায় মামলা রেকর্ড হয়ে যাবে বলে মৃদস্বরে হুমকি দেওয়া হয়। নতুন করে কোনো মামলা রেকর্ড হয়নি বলে জানা গেছে।
পলকের সঙ্গে তাদের তিনজনের এই কথোপকথনের ঘটনা ঘটেছে গত রোববার। তিনজনের পৃথক তিনটি অডিও ক্লিপ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন যুবলীগ নেতা পলক।
৩ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডের একটি কল রেকর্ডে সানোয়ারকে বলতে শোনা গেছে, বিস্ফোরক ও আগ্নেয়স্ত্র মামলা হবে। ওই মামলার একটা কপি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে চলে গেছে। তারাই এ মামলা করাচ্ছে। আমি, তুমি এই মামলা দিলে নিবে? প্রশ্নের সুরে বলেন তিনি। ওই তালিকাতে তোমার নাম আছে। ওখান থেকে নাম বাদ দিলে ঝামেলা হবে। পলক খরচ দিতে চাইলে সানোয়ার বলেন খরচের বিষয় নেই এখানে। আমি যদি তোমাকে সেভ করি তাহলে বিএনপির কেউ এটা নিয়ে কথা বললে সমস্যা আছে। বিএনপির কেউ জানবে না, অনেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে। এজন্য সম্প্রতি হওয়া দুটি মামলাতে আমার নাম নেই বলেন পলক।
এসব শোনার পর হাসতে হাসতে সানোয়ার বলেন, সবই বুজলাম। এ সুযোগে উপরের কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করতে বলেন পলক। জবাবে সানোয়ার নরম সুরে বলেন, না ওগুলো ওইভাবে হবেনা। এরপর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সালাম ও সাজ্জাদ নামের দুইজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে বিষয়টি স্বরণ করে দিয়ে আবারও সালাম ও সাজ্জাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।
এরপর ১ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের কল রেকর্ডে পলক সাজ্জাদের কাছে কথা হয়েছে কিনা জানতে চায়। জবাবে সাজ্জাদ বলেন, ভাই পরের দিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) ১২টা পর্যন্ত টাইম দিয়েছে। সালাম আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তখন পলক জানতে চায় কি পরিমাণ টাকা জোগাড় করবো জবাবে এগুলো ফোনে হয়না, সরাসরি করতে হয়।
গর্ব করে এলাকার চারজনকে সেভ করেছি জানিয়ে সাজ্জাদ বলেন, ওদেরকে লুঙ্গি খুলে ঘুরতে বলেছি। ওরা সেই সময় আমাকে হেল্প করেছিল। যারা হেল্প করেছে তাদেরকে আমি হেল্প করছি। তাই সালাম ভাই এসে টাকার পরিমাণ বলছে। ভাই বলে দিয়েছে।
সর্বশেষ ৩ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের একটি কল রেকর্ডে শোনা যায়, সালাম নামের ওই ব্যক্তি পলকের কাছে জানতে চায় পকেটের কি অবস্থা, খরচের কিছু আছে কি? তার কাছে নেই বিষয়টি পলক জানালে সালাম একাধারে বলতে থাকে, আচ্ছা যাই হোক, সাজ্জাদ কাল দুপুর পর্যন্ত টাইম নিয়েছে। দুপুরের পর ওটা কিন্তু রেকর্ড হয়ে যাবে। যতো তাড়াতাড়ি পারো বিকাশে কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও। এছাড়া ফিগারের কথা (টাকার পরিমাণ) জিজ্ঞেস না করার কারণে উল্টো স্মরণ করে দেন পলককে। এরপর ৫০ হাজার দেওয়া লাগবে। তবে ত্রিশ হাজারের নিচে সম্ভব না। মানে দুই জায়গায় দেওয়া লাগবে। তাই ওইটা দাও, পরের যে ইয়াগুলো আছে সেটা দেখা যাবে। এছাড়া তোমার আর আমার মিটিং করা লাগবে বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে বিএনপি সমর্থক সালাম মুঠোফোনে বলেন, আমি রাজনীতির সঙ্গে তেমন জড়িত না। টাকা চাওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছিল। তবে ওইরকম বিষয় না। সানোয়ার ভাই এটা ইয়ে করছিল। যাই হোক এটা নিয়ে সাক্ষাতে কথা বলব।
মামলা থেকে বাদ দিতে পেরেছেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার সবকিছুই জানার বাহিরে। আমাকে বলতে বলেছে। আর বলেই দোষের মধ্যে পড়েছি। সানোয়ার ভাই ও সাজ্জাদও জানে। তবে টাকা দিয়েছে কিনা সেটা আমি বলতে পারব না।
মুঠোফোনে জানতে চাইলে সাজ্জাদ বলেন, আমি সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের দরিয়াপুর এলাকার বিএনপির সমর্থক। পলকের নানার বাড়ি ও আমার নানার বাড়ি টাঙ্গাইলে। তাই তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। তারপরও এগুলোর জন্য আমাকে পলক কেন ফোন দিয়েছে, সেটা জানতে চেয়েছিলাম। আমি কোনো বিষয়ে জানি না। বিষয়টি জানি না জন্য সালামের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি। তবে কৌশলে সেসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
জানতে চাইলে সব বিষয় অস্বীকার করে বিএনপি নেতা সানোয়ার হোসেন মুঠোফোনে বলেন, পলককে আমি চিনি না। কখনও ফিজিক্যালি দেখিনি। সে আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ভাই আমি পলক। সে আমাকে বারবার উসকানি দিয়ে টাকার কথা বলছিল। আমি প্রশ্রয় দিইনি। বিরক্ত হয়েছিলাম। সেই জন্য সালামের ও সাজ্জাদের মোবাইল নাম্বার দিইনি।
মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সানোয়ার বলেন, এখনও মামলা করা হয়নি। তবে মামলা করব। গোয়েন্দা সংস্থা মামলা করতে পারে না। তাদের সহযোগিতা নিয়ে আমরা মামলা করব।
গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তালিকা চলে গেছে এমন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই এটা কোনো বড় বিষয় না। সালামের টাকা চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সে কি বলেছে, সেটা আমার জানার কথা না।
এছাড়া সাজ্জাদ ও সালামকে দেখিয়ে দিলেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পলকের দোস্ত (বন্ধু) লোক সালাম ও সাজ্জাদ। আওয়ামী লীগের সময়ে পলকের সঙ্গে তাদের খাতির ভালো ছিল। সেই জন্য আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি।
রাণীনগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোসারব হোসেন বলেন, বিএনপির নাম ভেঙে বা বিএনপির সঙ্গে জড়িত থেকে কেউ অন্যায় করবে ও চাঁদাবাজি করবে, আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সেটা মেনে নেব না। সানোয়ারের বিরুদ্ধে এ রকম যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।