চট্টগ্রামের আবাসিক হোটেল ও বাসাবাড়ি গুলোতে প্রকাশ্যে চলছে দেহব্যবসা

কামরুল ইসলাম: 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে যুগ যুগ ধরে দেহব্যবসা চলে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। শুধুমাত্র আবাসিক হোটেল নয়, বাসাবাড়িতেও এই অবৈধ ব্যবসা দেদারসে চলছে। ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারীরা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রবাসীর স্ত্রী, গার্মেন্টস কর্মী, বিউটিশিয়ান এবং উঠতি বয়সের কিছু তরুণী এতে জড়িয়ে পড়ছে।

সামাজিক সংগঠনগুলোর মতে, প্রেমে ব্যর্থতা, স্বামীর নির্যাতন, মাদকাসক্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিলাসিতা, অতিরিক্ত যৌন আকর্ষণ ও দারিদ্র্য—এসব নানা কারণে নারীরা এই পেশায় জড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, চেহারার গঠন ও সৌন্দর্য্যের ওপর ভিত্তি করে এসব নারীর ‘মূল্য’ নির্ধারণ করা হয়—১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত।

বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, নগরীতে কয়েক হাজার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ‘ক্লাস’ বা ‘চাকরি’র নাম করে বাইরে গিয়ে মূলত দেহব্যবসায় জড়িত। কেউ কেউ বাসা ভাড়া নিয়ে, আবার কেউ রিসোর্ট বা গেস্ট হাউসে গিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক নারী নিজের পরিচয় গৃহবধূ বা ছাত্রী হিসেবে দিয়ে দালালদের মাধ্যমে খদ্দরের সংস্পর্শে আসছে।

অপরদিকে, বিউটি পার্লারগুলো এই ব্যবসার আড়াল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সুন্দর চেহারার মেয়েদের পার্লারে নিয়োগ দিয়ে পার্লার মালিকরা বাড়তি আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দেহব্যবসায় নামিয়ে দিচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড পার্লারের বাইরে, ভাড়া করা বাসায় চালানো হয়। অনেক শিক্ষার্থী ও গৃহবধূ প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারানোর অভিযোগও করেছেন।

একটি সংঘবদ্ধ চক্র গ্রাম থেকে হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শহরে এনে দেহব্যবসায় জড়িত করে। প্রথমে টাকার লোভ, পরে জোরপূর্বক, একসময় মেয়েটি নিজেকে মানিয়ে নেয় এই অন্ধকার জগতে এবং হয়ে ওঠে একজন পেশাদার যৌনকর্মী।

শহরের বহদ্দারহাট, ২নং গেইট, জিইসি মোড়, অলংকার, নিউ মার্কেট, আগ্রাবাদ, বারেক বিল্ডিং ও পতেঙ্গা—এসব এলাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। সামান্য টাকার বিনিময়ে তারা খদ্দরের সেবা দেয়, আবার অনেক সময় হোটেলে তুলে খদ্দরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

নগরীর ফয়েজ লেক, স্বাধীনতা পার্ক ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের আশপাশের হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও গেস্ট হাউসগুলোও এই অসামাজিক কার্যকলাপের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নামি হোটেলগুলোর অন্তরালে চলছে অবৈধ কর্মকাণ্ড।

ফয়েজ লেকে ‘রিয়েল পার্ক’, ‘লেক সিটি’, ‘লেক পয়েন্ট রিসোর্ট’, ‘লেক গার্ডেন’ ও ‘স্বর্ণালী’ নামে পাঁচটি আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন তরুণ-তরুণী ও যৌনকর্মীরা ভিড় করে। অনেক হোটেল বাইরে থেকে নিয়মতান্ত্রিক মনে হলেও ভেতরে চলছে পতিতাবৃত্তির রমরমা ব্যবসা।

স্বাধীনতা পার্ক ও পতেঙ্গা সৈকতেও প্রেমিক যুগল ও যৌনকর্মীদের অবাধ যাতায়াত লক্ষ করা গেছে। সন্ধ্যা হলে তারা বিভিন্ন হোটেলে গিয়ে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়।

বিশ্বস্ত সূত্র মতে, এসব হোটেল পরিচালিত হয় মালিকদের বিশ্বস্ত লোকদের মাধ্যমে। রিসিপশনে একজন অতিথির মতো দেখা গেলেও, ভেতরে চলতে থাকে অবৈধ লেনদেন।

নগর পুলিশের কমিশনার জানিয়েছেন, একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ সদস্য ও হোটেল মালিকদের সমঝোতার বিষয়টি অস্বীকার করেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোটেল মালিক জানান, “সব হোটেল মেয়ে রাখে না, তবে অনেক প্রেমিক যুগল আসেন। কেউ বিশেষ চাহিদা জানালে দালালের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হয়। এ কাজ গোপনে চালাতে প্রশাসন ও নেতাদের মাসোহারা দিতে হয়।”

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু শহর বড় হওয়ায় সব জায়গায় একযোগে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। যদি আপনারা তথ্য দেন, আমরা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।”

তিনি আরও বলেন, “অসামাজিক কার্যকলাপ রোধে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তবেই এই চক্র ধ্বংস করা সম্ভব, শুধু অভিযান চালিয়ে নয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *