ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ: যুদ্ধবিরতি, প্রশ্ন এবং কৌশলগত গোলকধাঁধা

স্বাধীন আন্তর্জাতিক ডেস্ক:  

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে গড়িয়েছে যুদ্ধবিরতির ১২ দিন। যদিও অস্ত্রের শব্দ আপাতত থেমেছে, উত্তেজনা ও সংশয় এখনও কাটেনি—বিশেষ করে ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকে।

সন্ত্রাসী হামলার জবাব ও কৌশলগত অভিযান

প্রায় দুই সপ্তাহ পর ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে নয়টি স্থানে অভিযান চালায়, যেগুলোকে “সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি” বলে দাবি করা হয়েছে। এর জবাবে পাকিস্তানও ড্রোন হামলা চালায় সীমান্তের ভারতীয় অংশে।

যদিও দুই পক্ষই একাধিক দাবি ও পাল্টা অভিযোগ করেছে, অধিকাংশ তথ্য এখনও যাচাই হয়নি। অনেক প্রশ্নের উত্তর অধরাই রয়ে গেছে—বিশেষ করে এই সংঘর্ষে কারা জড়িত ছিল, কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো কীভাবে?


কে ছিল পেহেলগাম হামলার পেছনে?

জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ হামলাকারী হিসেবে তিনজনকে চিহ্নিত করেছে—একজন কাশ্মীরি ও দুইজন পাকিস্তানি। তাদের মধ্যে আদিল হুসেন ঠোকার, হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা ভাইয়ের নাম উঠে এসেছে। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু তারা কোথায়? এখনো তারা ধরা পড়েনি কিংবা নিহত হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলেনি ভারত।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) জীবন রাজপুরোহিত বলছেন, সন্ত্রাসী নির্মূল কঠিন কারণ তাদের স্থানীয় সমর্থক এবং বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস করতে হলে শুধু অস্ত্র নয়, আদর্শগত কাঠামোকেও ভাঙতে হবে।


সীমান্তে হতাহত এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশ্ন

সংঘর্ষে বেসামরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হতাহত হওয়ার খবর মিললেও, কোনো সুনির্দিষ্ট সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে—কেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের আগেভাগে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়নি?

এয়ার মার্শাল (অব.) দীপ্তেন্দু চৌধুরী বলছেন, এটা “পুরোপুরি যুদ্ধ” না হওয়ায় এবং হঠাৎ করে সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় আগে থেকে মানুষ সরিয়ে নেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায়নি। তবে সীমান্ত এলাকায় আগে থেকেই বাংকার, সাইরেন ও ব্ল্যাকআউট প্রটোকল চালু আছে।


যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি: সত্য না প্রচার?

পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। অন্যদিকে, ভারতের পক্ষ থেকে এ দাবি নিশ্চিতও করা হয়নি, অস্বীকারও নয়।

এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় এয়ার মার্শাল একে ভারতী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা, সেটা আমরা অর্জন করেছি। আর সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছেন।” এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়, ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সরাসরি প্রকাশ না করাটাই এই মুহূর্তে ভারতীয় কৌশলের অংশ।


যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা: মধ্যস্থতা না কৌশলগত সমন্বয়?

যুদ্ধবিরতির আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তার সরকারের মধ্যস্থতায় দুই দেশ সংঘর্ষ বন্ধে সম্মত হয়েছে।

ভারত সরাসরি এই দাবিকে অস্বীকার না করলেও স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তারা বলছে, পাকিস্তানের ডিজিএমও-র উদ্যোগেই যুদ্ধবিরতির পথ খুলেছে। সাবেক কূটনীতিক দিলীপ সিংয়ের মতে, পাকিস্তান হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধবিরতির পথ তৈরি করেছে।


বিরোধীদের প্রশ্ন: যুদ্ধবিরতির পেছনের সত্য জানতে চায় তারা

বিরোধী দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে—এই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো? যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল? কেন সংসদ বা রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি?

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামরিক কৌশলের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক আলোচনার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক চন্দ্রচূড় সিং বলছেন, “যে সিদ্ধান্তে সামরিক গোয়েন্দা ও কৌশলগত উপাত্ত জরুরি, সেখানে বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শের রেওয়াজ নেই।”


শেষ কথা: যুদ্ধ নয়, কৌশলই মুখ্য

এই সংঘর্ষ, যুদ্ধবিরতি ও পরবর্তী উত্তেজনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আধুনিক যুদ্ধের ক্ষেত্র এখন শুধু মাঠের লড়াই নয়, তথ্য, কৌশল ও জনমত-গঠনের লড়াইও বটে।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন বরাবরই সেনা ও কূটনৈতিক মহলে উত্তেজনার জন্ম দেয়। তবে সামরিক শক্তি নয়, বাস্তব কৌশল ও আঞ্চলিক শান্তিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *