আওয়ামীপন্থী প্রকৌশলী খাইরুল বাকেরের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার:

নাম তার খাইরুল বাকের, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সবাই গা ঢাকা দেন। অনেক নেতা-কর্মীরা দেশত্যাগ করেন, আবার অনেকে পালাতে গিয়ে আটক হন। কিন্তু সম্পূর্ণ ধরা ছোঁয়ার বাইরে, এই আওয়ামী দোসর খাইরুল বাকের।

৫ই আগস্টের পূর্বে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে একাধিক পোস্ট ও কমেন্ট করে ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ছাত্র আন্দোলনকে বিতর্কিত ও প্রতিহত করার চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি এই খাইরুল বাকের।

খাইরুল বাকের ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে। তারা ৬ ভাই। তার বাবা মিন্নত আলী ছিলেন নৌকার মাঝি। তার বাবা খেয়া পারাপারসহ কুলির কাজও করেছেন। দিন এনে দিন খাওয়া এই খাইরুল বাকের ২০০১ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে যোগদান করার পর থেকেই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পায়। এরপর থেকেই তার স্ত্রী ও পাঁচ ভাইয়ের সম্পত্তি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

জানা যায়, খাইরুল বাকের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ৫ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদন দিতেন।

খাইরুল বাকেরের একটি ঘুষ লেনদেনের ভিডিও আমাদের হাতে এসেছে। তাছাড়াও তার বড় ভাই আলাউদ্দিন, খাইরুল বাকেরের দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের কাছে অকপটে সব স্বীকার করেন।

খাইরুল বাকেরের নামে-বেনামে রয়েছে আনুমানিক ৬০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তি। স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি, খাইরুল বাকের আনুমানিক ১৫০০ কোটি টাকার মালিক। নিকট আত্মীয়দের নিয়ে সিন্ডিকেট করে তার ৫ ভাই, ২ ছেলে ও স্ত্রী জেবুন নাহারের নামে ঢাকা ও নরসিংদীসহ রয়েছে অন্তত ১৩টি বাড়ি ও ৬০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ।

আমাদের করা দীর্ঘ ১১ মাসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই আওয়ামী দুর্বৃত্তের দুর্নীতির ভয়াবহ তথ্য।

ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে খাইরুল বাকের ছিলেন নরসিংদী বেলাবো-মনোহরদী উপজেলার আওয়ামী লীগের অর্থদাতা। স্বৈরাচার সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারণায় খাইরুল বাকের অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করারও অভিযোগ উঠে। খাইরুল বাকের বেলাবো ও মনোহরদী উপজেলার আওয়ামী লীগের অর্থদাতা হিসেবেও পরিচিত।

ছাত্রজীবনে খাইরুল বাকের চুয়েট (চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) শহীদ তারেক হুদা হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এর প্রমাণ হিসেবে ২০২২ সালের ২৬ জুন দৈনিক ভোরের পাতায় “দুর্নীতির টাকায় অঢেল সম্পদ তার, এলাকায় দানশীল!” শিরোনামে খাইরুল বাকেরের অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে সেই প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ দিয়ে সেখানে নিজেকে ছাত্রলীগ দাবি করেন খাইরুল বাকের। তার বন্ধু কাজী শামীমের ফেসবুক স্ট্যাটাসেও তা স্পষ্ট।

সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে:
নিকট আত্মীয় সিন্ডিকেট করে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে তিন ভাইয়ের নামে রয়েছে ৪টি বাড়ি। বড় ভাই আলাউদ্দিনের নামে ২টি, ছোট ভাই হোসেন আলীর নামে ১টি ও বড় ভাই রাশেদ মিয়ার নামে ১টি।

খাইরুল বাকেরের নিজ নামে খিলগাঁও তালতলায় অতশী লাবণী বিল্ডিংয়ে রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের ১টি ফ্ল্যাট।

তার স্ত্রী জেবুন নাহার, যিনি সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কমন সার্ভিস ডিভিশনে এজিএম হিসেবে কর্মরত, তার নামে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আই ব্লকে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছয়তলা ভবনের ৪তলায় ৬ কোটি টাকা মূল্যে ক্রয় করা ২টি ইউনিট রয়েছে।

স্ত্রী জেবুন নাহারের নামে সিপাহীবাগ খিলগাঁওয়ে ১টি বাড়ি, পূর্বাচল প্রকল্পে সেক্টর:১০, ৪০৭/সি রোডে ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৩ কাঠার একটি প্লট এবং একটি টয়োটা প্রাইভেট কার রয়েছে।

ছোট ভাই খাইরুল হাসানের নামে নরসিংদীর ভেলানগরে একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে।

নরসিংদী জেলার বেলাবো থানাধীন নারায়ণপুর বাজারে খাইরুল বাকের ও তার ছোট ভাই খাইরুল হাসানের নামে রয়েছে আরও ২টি বাড়ি। এছাড়াও নারায়ণপুর বাজারে বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তি জমি কিনে রেখেছেন এই আওয়ামী দুর্বৃত্ত।

নিজ বাড়িতে রয়েছে ৩ কোটি টাকা মূল্যের আলিশান তিনতলা কমপ্লিট একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ রয়েছে আনুমানিক ৬০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তি।

এই বছরের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তার অপকর্ম নিয়ে একটি অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর প্রধান কার্যালয়ে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন খাইরুল বাকের।

তার এই দুর্নীতির ফিরিস্তি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে এশিয়ান টেলিভিশনের রিপোর্টার খাইরুল বাকেরের গ্রামের বাড়ি নারায়ণপুর বাজারে গেলে আওয়ামী লীগের দালাল খাইরুল বাকেরের পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তার ছোট ভাই খাইরুল হাসানের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী এশিয়ান টেলিভিশনের রিপোর্টার মেহেদী হাসান কবিরের উপর হামলা চালায়।

পরে তাদের গুরুতর আহত অবস্থায় বেলাবো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আওয়ামী ধূসর খাইরুল বাকেরকে প্রধান আসামি করে, তার ছোট ভাই খাইরুল হাসান ও সবুজসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, ক্যামেরা ভাঙচুর এবং চুরির মামলা করা হয়।

পরে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিকের নির্দেশক্রমে, নরসিংদীর পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান ও বেলাবো থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মীর মাহবুবের সহযোগিতায় রাজিবুল ইসলাম ওরফে রাজিবকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারের জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে রাতভর অভিযান পরিচালনা করা হয়।

খাইরুল বাকেরের স্ত্রী জেবুন নাহারের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে একজন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে দাবি করেন।

তার এই লাগামহীন দুর্নীতির বিষয়ে একাধিকবার বক্তব্য নিতে গেলে অফিসে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও অতিরিক্ত সচিব মোঃ শাহজাহান মিয়া বলেন, “খাইরুল বাকেরের বিষয়টি সম্পর্কে আমি ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেব।”

নিজ এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা খাইরুল বাকেরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ফেস্টুন, ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়।

এই আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ৫ই আগস্টের পরেও স্বপদে বহাল রয়েছেন। এখন আবার ভোল পাল্টে পদোন্নতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার ধান্দা করছেন এই আওয়ামী দোসর খাইরুল বাকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *