মিরপুর বিআরটিএর কর্মকর্তা রাকিবের দুর্নীতি আখড়া, টাকা ছাড়া ফাইলে সই হয় না

সুমন খান:


বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) মিরপুর অফিসের সব সেবা ঘুষ, দুর্নীতি ও দালালচক্রে আটকে গেছে। কর্মকর্তা রাকিবের কাছে এমন একটি চিত্র সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে। দালাল-পরিবেষ্টিত এ অফিসে দীর্ঘদিন ধরে থাকা কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের ‘বিশ্বস্ত দালালচক্র’ তৈরি করেছেন এই রাকিবকে ঘিরেই। তাদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছেন অফিসে সেবা নিতে আসা সাধারণ জনগণ। ভুক্তভোগীরা জানান, ঘুষ ও দালাল ছাড়া কোনো সেবা মেলে না। অন্যথায় হতে হয় হয়রানির শিকার।

কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা বদলি বা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে আবেদন ও সাপোর্টিং ডকুমেন্টে নানা রকম ভুল ধরে হয়রানি করা হয়। ফলে হয়রানি এড়াতে বাধ্য হয়েই দালালের শরণাপন্ন হতে হয়।

কয়েকজন সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, টাকা ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া এখানে অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। মিরপুর বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা বদলি এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সব কিছুই দালালদের নির্ধারিত হারে ঘুষ দিয়ে করাতে হয়। সেবার বিষয়ে কর্মকর্তারা বরাবরই নীরব থাকেন।

বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দালালদের সাজা দেওয়া হলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রকরা অধরাই থেকে যায়। বিশেষ করে মিরপুর মালিকানা বদলি শাখার ১১৬ নম্বর রুমে গ্রাহকদের হয়রানির শেষ নেই। অফিস সহকারী রাকিব মোবাইল ফোনের মতো ওয়েটিং রেখে একের পর এক ফাইল প্রসেস করেন। যদিও সরকারি অফিস ৪টা পর্যন্ত, রাকিব ও তার সহযোগীরা রাত ১০টা পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় কাজ চালিয়ে যান—যা গণমাধ্যমের চোখে পড়ে।

মো. রাকিব তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে গ্রাহকদের কাগজপত্র ‘ঠিক করে’ দেওয়ার নাম করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রয়েছে—জিকু, রাশেদ, জসিম, সুমন, গিয়াস, কবির এবং আরও অনেক নতুন দালাল। সরকারি অফিস বন্ধ থাকলেও তারা ‘গার্মেন্টস কোয়ালিটির’ মতন ওভারটাইম করে টাকার বিনিময়ে কাজ চালিয়ে যায়।

এই সুযোগে দালাল চক্রটি গ্রাহকদের ফাইল দেখে নানা অজুহাতে ভয়ভীতি দেখায়। সন্ধ্যার পর তারা লাইট বন্ধ করে অন্ধকারে লেনদেন করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, বিক্রেতা ও ক্রেতা দুজনই উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বলা হয় ‘মোটরযান পরিদর্শক ১১১ নম্বর রুমে যান, ফাইল মার্ক করে নিয়ে আসুন’। সেখানে গেলে আবার সহকারী পরিচালক মো. শেখ রাজিবুল ইসলামের কাছ থেকে মার্ক করে আনতে বলা হয়। পরে বড় কর্তার কাছে গেলে তিনি বলেন, “হু ইজ মার্ক?”—এরপর ইংরেজিতে বিভ্রান্তিকর কথা বলে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি করা হয়। অথচ, এসব ‘ইংলিশ’ কথাবার্তার অনেকটাই তিনি নিজেই বুঝেন না।

অনেক গ্রাহক জানান, টাকা দিলে সহজেই কাজ হয়ে যায়, না হলে ঘুরপাক খেতে হয় রুম থেকে রুমে। বিশেষ করে ১১৬ নম্বর রুমে বারবার যেতে হয়। এই সুযোগে রাকিবের দালালচক্র গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি ফাইলে ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে।

অনেকেই অভিযোগ করেন, “ভাই, অবস্থা খুব খারাপ, এত টাকা কেন দেব?” তখন রাকিব বা তার দালালরা বলেন, “আগে সিস্টেম ছিল না, এখন সিস্টেম অনেক জটিল হয়ে গেছে। বড় অফিসারদেরও দিতে হয়।”

সরেজমিনে দেখা যায়, রাকিবের লোকজন মুখে মাস্ক পরে অফিসার সেজে ভিডিও কলে বিক্রেতার উপস্থিতি নিশ্চিত করছে। অভিযোগ রয়েছে, এই একটি সেকশন থেকেই রাকিবের মাধ্যমে মোটরযান পরিদর্শক (১১১ নম্বর রুম) এবং সহকারী পরিচালক মো. রাজিবুল ইসলাম প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা নিচ্ছেন।

জনস্বার্থে এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই তথ্য-চিত্রভিত্তিক প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *