স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
যুক্তরাজ্যে সফররত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে একটি বৈঠক হতে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। আগামী ১৩ জুন, শুক্রবার লন্ডনের স্থানীয় সময় সকালে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। মুকিমুল আহসানের করা বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
এমন সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতার এই বৈঠক হচ্ছে, যখন আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকার ও বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।
বিএনপির বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠকের ব্যাপারে সরকার প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, শুরুতে বিএনপির পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের ব্যাপারে অতটা আগ্রহ ছিল না। তবে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় শেষ পর্যন্ত দলটি বৈঠকে সম্মতি দিয়েছে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈঠকের উদ্যোগ আমাদের পক্ষ থেকে ছিল না। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা ব্রিটেনে যাচ্ছেন, তিনি মনে করেছিলেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করবেন। এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ। দেখা না করলে তা সঠিকভাবে নেওয়া হতো না।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়, যেখানে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
মঙ্গলবার সকালে অনানুষ্ঠানিক এক ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে। তিনি মনে করেন, এই বৈঠক থেকে নতুন দিকনির্দেশনা ও সুযোগ তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট কাটানোর উদ্যোগ হিসেবেই দেখছেন।
বৈঠকে বসতে রাজি হওয়ার পেছনের গল্প
চার দিনের সরকারি সফরে সোমবার ঢাকার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৫ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান।
প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের ঘোষণা আসার পর থেকেই তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়।
যদিও আলোচনা চলছিল, সোমবার পর্যন্ত সরকার বা বিএনপির পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসে নি।
তবুও ভেতরে ভেতরে এই বিষয়ে কিছু আলোচনা ও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা গত দুই দিনে সরকারের ও বিএনপির পক্ষ থেকেও প্রকাশ পেয়েছে।
সেই দিন রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়, যেখানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি তারেক রহমান যুক্ত হন।
সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি জানিয়েছে, ১৩ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত লন্ডনের হোটেল ডোরচেস্টারে বৈঠক হবে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৈঠকের মূল আগ্রহ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের, তাই দলটি সম্মত হয়।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যতই কিছু হোক, সৌজন্য বজায় রাখা জরুরি। স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করা উচিত। প্রয়োজনে রাজনৈতিক আলোচনা হবে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বৈঠকটি বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই আলোচনায় ছিল। লন্ডনে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থাকায় একটা সাক্ষাতের সম্ভাবনা ছিল। তারেক রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং আমরা আশা করছি, এটা রাজনৈতিক সংকট কাটাতে সহায়ক হবে।’
তিনি আরও বলেন, এই বৈঠক আগামী দিনের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
বিএনপি কেন এটিকে টার্নিং পয়েন্ট মনে করছে?
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ সিটিতে ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ইস্যুতে সরকার ও বিএনপির মধ্যে উত্তেজনা ছিল। এরপর এপ্রিলে নির্বাচন সময় নির্ধারণের ঘোষণা বিএনপির তীব্র প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে।
ঈদের পর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল দলটি।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি আলোচনা করেন।
সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, সরকারের আগ্রহের কারণে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে রাজি হন তারেক রহমান।
শুরুতে বিএনপি দোটানায় ছিল, তবুও দল এটিকে রাজনীতির ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে দেখছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের এই বৈঠক একটি মাইলফলক হতে পারে, যা সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের তিক্ততা কমাতে সাহায্য করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে সরকারের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সংকট কাটানো খুবই জরুরি, যা দেশের জন্যও প্রয়োজনীয়।’
তিনি মনে করেন, সংকট কাটাতে এই বৈঠক একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।
নির্বাচনের সময় নিয়ে সংকট নিরসন?
গত কয়েক মাসে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অটল ছিল।
গত মাসে ঢাকায় এক সমাবেশে তারেক রহমান স্পষ্টভাবে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়ার কথা বলেন।
এরই মাঝে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ৬ জুন কুরবানির ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা দেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে হবে।
এ ঘোষণার পর বিএনপি কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এপ্রিলে নির্বাচনের ব্যাপারে আপত্তি জানায়।
বৈঠকের পর প্রশ্ন উঠেছে, এই বৈঠকের ফলে বিএনপি তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে কিনা?
কিছু গণমাধ্যমে খবর এসেছে, এই বৈঠকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের দাবি আসতে পারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা আশা করি সরকার বাস্তবতার দৃষ্টিতে বিষয়টি বিবেচনা করবে। সময়টা সঠিক নয়, কারণ রোজার মাস, ঈদ শেষ হবার কয়েক দিন পরই নির্বাচন।’
তিনি বলেন, ‘রোজার সময় প্রচারণা চালানো কঠিন হবে, প্রচারণার খরচও বাড়বে। গরমে দিনের আলোতে লোকজন জনসভায় আসবে না, রাতেও মিটিং করতে হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বৈঠক নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সংকট কিছুটা সমাধান করতে পারে।
কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলা যায় না, সবসময় নতুন সম্ভাবনা থাকে। এই বৈঠক নির্বাচনের সময় নিয়ে সংকট কমাতে সাহায্য করতে পারে।’
বিশ্লেষকরাও এই বৈঠককে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণকারী ঘটনা হিসেবে দেখছেন।