স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
কুরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ মূলত এতিম ও দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চামড়ার অর্থ এতিমের হক হওয়া সত্ত্বেও এবারও সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র থামাতে পারেনি বাজারের অবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে চামড়ার বাজারে ধস নামিয়ে দিয়েছে, যার ফলে কুরবানিদাতা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা প্রকৃত মূল্য পাননি। অনেক ক্ষেত্রে পানির দর বৃদ্ধির কারণে ক্ষোভে চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। বাধ্য হয়ে অনেকেই কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় চামড়ার সঠিক মূল্য পাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও সিন্ডিকেট সেই আশা পূরণে বাধা সৃষ্টি করেছে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে চামড়ার বাজারে সরকারের নেওয়া কিছু নীতিমালা রয়েছে। প্রথমত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়া (ওয়েট ব্লু) বিদেশে রপ্তানি উন্মুক্ত করেছে। যদিও আগে এটি নিষিদ্ধ ছিল, ঈদের পরবর্তী তিন মাসের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে এলসি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে রপ্তানি সুষ্ঠুভাবে হয়। এতে লবণ মিশিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা সিন্ডিকেটের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দেয়।
এছাড়া প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও, একশ্রেণির ব্যবসায়ী সেটি মানতে পারেননি। তাদের মতে, বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ হওয়া উচিত। নির্ধারিত মূল্য বৃদ্ধিও সিন্ডিকেটের জন্য আঘাত স্বরূপ।
মৌসুমি ও মাদ্রাসার বিক্রেতারা প্রতিবছর কুরবানির চামড়া কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন। সরকার মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিনামূল্যে সাত লাখ মন লবণ বিতরণ করে এ সমস্যা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেছে। এই লবণ পেয়ে ইতোমধ্যে চার লাখ পিস গরু ও দুই লাখ পিস ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। সংরক্ষিত চামড়া তিন মাস পর্যন্ত বিক্রি না করলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু সিন্ডিকেট এই উদ্যোগ মেনে নিতে পারছে না এবং বাজারে পরিকল্পিতভাবে ধস নামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফলস্বরূপ, অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। পানির দরে হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ক্ষোভে রাস্তায় চামড়া ফেলে দিয়েছেন। এবছর চামড়ার লেনদেন প্রায় তিনশ কোটি টাকা হওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও, এই ধস ও সিন্ডিকেটের অপচেষ্টায় এতিম ও দুস্থদের পাওনা টাকা বঞ্চিত হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অপপ্রচার চালিয়ে কুরবানির চামড়ার বাজারে ধস নামানোর চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন মহল থেকে সহায়তা পাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রায় এক কোটি পশু কুরবানি হয়েছে এবং সাত লাখ মন লবণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে, যা তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট এই উদ্যোগ ধ্বংসের চেষ্টা করছে। যারা লবণ নিয়েছেন, তারা নির্ধারিত দামের বেশি পেয়েছেন, কিন্তু যারা নেননি, তারা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে এক লাখ পিস চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে এমন খবর অপপ্রচারের অংশ। প্রকৃত সংখ্যা অনুমানভিত্তিক মাত্র ১০ হাজার পিস। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মিথ্যা খবর ছড়িয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি তৈরি করা হয়েছে, যার কারণে অনেকে কম দামে বিক্রি করেছেন।
চামড়ার ট্যানারিশিল্প মালিকরা জানান, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণে ত্রুটি থাকায় শিল্প কমপ্লায়েন্স পাননি। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের চামড়া চাহিদা কমে যাচ্ছে, আর চীনই একমাত্র ভরসা। তবে চীনও বাংলাদেশের চামড়া কম দামে কিনছে। এছাড়া ট্যানারির মালিকরা জানিয়েছেন, কম সুদের ঋণ না পেলে শিল্পের উন্নতি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ)-এর সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের বলেন, বর্তমানে সব ট্যানারি লোকসানে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কম চাহিদার কারণে কাঁচা চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে চামড়া কিনতে আগ্রহী নয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাভার ট্যানারিশিল্পে বর্তমানে পৌনে চার লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে, যার মধ্যে গরুর চামড়া ৩ লাখ ৬৫ হাজার এবং ছাগলের চামড়া ২১ হাজার পিস।