সুমন খান:
রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠা স্পা সেন্টারগুলোর আড়ালে একটি গোপন জগত গড়ে উঠেছে। সেখানেই চলছে দেহব্যবসা, মাদক সেবন এবং প্রভাবশালী চক্রের তদবির বাণিজ্য। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান এলাকায় একটি স্পা সেন্টারে অনুসন্ধানে গিয়ে সাংবাদিককে হুমকি দেওয়ার ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ উঠেছে, মিজান ও কামাল নামের দুই ব্যক্তি ‘স্পা ব্যবসার’ নামে অসামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাংবাদিক ও প্রশাসনের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছেন।
গুলশানের ২৪ নম্বর রোডের একটি বহুতল ভবনের ২য় ও ৩য় তলায় অবস্থিত ‘ইউনিকন লাক্সারি স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান দৈনিক সংবাদ দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর অবৈধ স্পা সেন্টারের মালিক মিজান ও তার সহযোগীরা অকথ্য ভাষায় সাংবাদিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বলেন, “তুই জানিস না আমি কে? পুলিশ র্যাব সব আমার। বেশি ঘাঁটলে তোকে গায়েব করে দেব। দেখে নিস”—সহ মিথ্যা মামলা দেওয়ার হুমকি দেন। তাছাড়া, “আমি এসব ব্যবসায় নতুন না, আমি সব বুঝি।” তবে যেকোনো গণমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হলে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজনৈতিক প্রভাবশালী, প্রশাসন, কিংবা কথিত গণমাধ্যম কর্মীদের দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাসহ হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে মিজান একটি নয় দুটি স্পা সেন্টারের মালিক বলে জানা গেছে। এদিকে তার সহযোগী কামাল আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “প্রতিবেদন করলে তোকে চেনা যাবে না। আমি চাইলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তোকে মাদক মামলায় ঢুকিয়ে দেব। প্রয়োজনে আমরাও টাকা পয়সা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করাবো।”
স্থানীয়দের ভাষ্য:
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরেই এই ভবনের একাধিক ফ্ল্যাটে ‘স্পা’ নামক সাইনবোর্ডে অশ্লীল কার্যকলাপ চলে আসছে। এক প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে এখানে সুন্দরী মেয়েরা আসে, পরে রাতভর অচেনা লোকজনের আনাগোনা চলে। অনেক সময় ঝগড়া-চেঁচামেচিও হয়। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।” একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, “আমরা কিছু বলতে পারি না। উপরে যারা আসে, তাদের গাড়ি ও ব্যবহারেই বোঝা যায়, তারা ক্ষমতাবান। ভবনের মালিকরাও কিছু বলেন না।”
স্পার আড়ালে অন্ধকার জগৎ
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, মিজান ও কামাল রাজধানীতে অন্তত ৩টি স্পা পরিচালনা করেন। গুলশান ছাড়াও বনানী ও বাড্ডা এলাকায় তাদের ‘ফ্র্যাঞ্চাইজড’ স্পা রয়েছে, যেখানে প্রায়ই দেখা যায় সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষদের। এসব স্পা সেন্টারে ভেতরে রয়েছে গোপন কক্ষ, যেখানে ক্যামেরা নিষিদ্ধ। সেখানে উচ্চমূল্যে “স্পেশাল প্যাকেজ” সেবা দেওয়া হয়, যার আড়ালে চলে দেহব্যবসা।
বিশেষ সূত্রে আরও জানা গেছে, মিজান ও কামাল কেবল স্পা-চালানই না, তারা বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাদকের সরবরাহও করে থাকেন। নারী কর্মীদের মাধ্যমে তারা উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করেও মোটা অঙ্ক আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হুমকির মুখে স্বাধীন সাংবাদিকতা:
ঘটনার শিকার সাংবাদিক বলেন, “আমি অনুসন্ধানের স্বার্থে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন যে, আমি যদি কিছু করি তাহলে তারা আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। একজন সাংবাদিক হিসেবে এটি ছিল অত্যন্ত ভীতিকর অভিজ্ঞতা।” ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, “একজন সাংবাদিক তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি প্রাণনাশের হুমকি পান, সেটি কেবল সাংবাদিকতার ওপর আঘাত নয়, এটি গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধেও হুমকি। আমরা দ্রুত আইনি পদক্ষেপ দাবি করছি।”
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, মিজান ও কামালের মতো ব্যক্তিরা বারবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দাবি করে নিজেদের রক্ষা করে চলেছেন। অভিযোগ আছে, তারা থানা-পুলিশ ও কিছু অসাধু র্যাব সদস্যের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন, যার ফলে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সাহস পায় না।
মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ:
‘বাংলাদেশ মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ফোরাম’-এর নির্বাহী পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, “একটি স্পা সেন্টারের আড়ালে যদি নারী নির্যাতন, দেহব্যবসা ও মাদক ব্যবসা চলে, সেটি ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। তার ওপর সাংবাদিককে হুমকি দেওয়ার ঘটনা এ চক্রের আসল রূপ উন্মোচন করেছে। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি—অবিলম্বে এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তা চাই:
দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিক মহল মনে করেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দেশে অপরাধ ও দুর্নীতির চিত্র উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ মিজান-কামালের মতো অপরাধীরা যদি প্রকাশ্যে সাংবাদিককে হুমকি দেয়, তাহলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মিজান ও কামালের মতো ব্যক্তিদের অপকর্ম ও প্রভাবশালীতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। তাদের বিরুদ্ধে আইনি তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে শুধু সাংবাদিক নয়, সমাজের নিরাপরাধ নাগরিকরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের দ্রুত তদন্ত ও অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছে দেশবাসী।