মোঃ ইসলাম উদ্দিন তালুকার:
চলতি বছরের ঈদুল আজহার ছুটিতে হঠাৎ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর মধ্যে বদলি বাণিজ্যের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আনন্দময় এই ছুটির মাঝেই কিছু কর্মকর্তার ঈদ আনন্দের পাশাপাশি যুক্ত হয় পছন্দের সার্কেলে বদলির সুযোগ। বিআরটিএর ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংস্থার অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এক আদেশে বিআরটিএ চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পালকে সরিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সুপারিশে অতিরিক্ত সচিব মো. ইয়াছিনকে নতুন চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মো. ইয়াছিনের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠতে থাকে। তিনি নিয়মিত বলতেন, এসব সরকারের নির্দেশে হচ্ছে, কিন্তু অনেকেই মনে করেন—প্রকৃতপক্ষে দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে এ কথা বলা হয়েছে।
বিশেষ করে আইনমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘সিএনএস’ কে বিভিন্ন সুবিধা দিতে এবং বিআরটিএ কর্মকর্তাদের রিসোর্টে নিয়ে ভোজে মত্ত করার মতো কর্মসূচির মূলে ছিল এই চেয়ারম্যানের সুবিধাভোগী চক্র।
১১ জুন প্রকাশিত এক আদেশে দেখা যায়, বিআরটিএ সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে চট্টমেট্রো-১ সার্কেলে, কক্সবাজার সার্কেলের মোহাম্মদ মামুনুর রশীদকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কেলে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কেলের মো. মহসিনকে চট্টমেট্রো-২ সার্কেলে বদলি করা হয়। যদিও আদেশে তারিখ দেওয়া হয়েছে ১৯ মে ২০২৫, বিআরটিএ সদর দপ্তরের সূত্র জানায় এটি আদতে করা হয়েছে ১১ জুন।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, মো. জিল্লুর রহমান ও মো. মহসিনকে পছন্দের সার্কেলে বদলির জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ গুনতে হয়েছে। তবে মামুনুর রশীদ টাকা দিতে না পারায় তাকে নীতিমালা লঙ্ঘন করে কম গুরুত্বের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কেলে বদলি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে সংস্থার ভেতরে ও বাইরে।
বিআরটিএর বদলি ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সাল থেকে মামুনুর রশীদ ‘গ’ ক্যাটাগরির সার্কেলেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল তাকে কক্সবাজার বদলি করা হলেও বান্দরবানের অতিরিক্ত দায়িত্বও বহাল ছিল। ঘুষ না দেওয়ার কারণে তার উচ্চ ক্যাটাগরিতে বদলি হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে পড়ে।
২০২৪ সালের অক্টোবরের দিকে কিছুদিন লটারির মাধ্যমে বদলির নীতি কার্যকর হলেও সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অন্যদিকে যেসব কর্মকর্তা একই লটারির মাধ্যমে দুর্বল সার্কেলে বদলি হয়েছিলেন, তারা পরবর্তীতে ঘুষ দিয়ে ঢাকাসহ ‘ক’ ক্যাটাগরির সার্কেলে আসতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু ঘুষ না দিতে পারায় মামুনুর রশীদের ভাগ্য ফেরেনি।
৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মো. ইয়াছিনকে বিআরটিএর চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে বদলি করা হয় এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দীন আহমেদ। নতুন চেয়ারম্যানের আদেশ বাতিল করানোর জন্য মো. ইয়াছিন শেষ সময় পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করলেও ব্যর্থ হন।
বিদায়ের আগে তিনি যেন দ্রুত সব সম্পাদন করতে চেয়েছেন। ৩ জুন তারিখের এক আদেশে দেখা যায়, নরসিংদী সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) শেখ মো. ইমরানকে ঢাকা মেট্রো-১ সার্কেলে এবং মো. রুহুল আমিনকে নরসিংদী সার্কেলে বদলি করা হয়। একইদিনে আরও একটি আদেশে কে. মো. সালাহউদ্দিনকে রাঙ্গামাটি থেকে চট্টমেট্রো-১ সার্কেলে বদলি করা হয়।
এর আগে ২০২৪ সালেএকাধিক পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার মধ্যে অন্যতম শিরোনাম ছিল ‘‘বিআরটিএ’র বদলিতে তুঘলকি কাণ্ড, মোটা অঙ্কের লেনদেনে নীতিমালা ভঙ্গ’’। সেখানে আবু আশরাফ সিদ্দিকীকে ঝিনাইদহ থেকে সিলেট সার্কেলে বদলি করার তথ্যসহ দুর্নীতির নানা প্রমাণ তুলে ধরা হয়।
২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আরও এক আদেশে বিআরটিএ সদর দপ্তরের কনডেমনেশন শাখার মো. জহির উদ্দিন বাবরকে ময়মনসিংহে এবং হাফিজুল ইসলাম খানকে হবিগঞ্জে বদলি করা হয়। অথচ হাফিজুল ইসলাম আগে থেকেই অসুস্থতা ও ছুটির মধ্যে ছিলেন। এতে প্রশ্ন উঠে—একই সার্কেলে কেন আবারো তাকে বদলি করা হলো?
সূত্র জানায়, এই দুটি বদলির নেপথ্যেও রয়েছে আর্থিক লেনদেন এবং প্রশাসন শাখার সুবিধা নেওয়ার পরিকল্পনা। হবিগঞ্জ সার্কেলে ইতোমধ্যে একমাত্র মোটরযান পরিদর্শক থাকায় নতুন করে কাউকে সেখানে বদলি করা অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয় ছিল।
এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।