মোঃ ইসলাম উদ্দিন তালুকদার :
ছাতক উপজেলা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অফিসে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। গ্রাহকসেবার নামে চলছে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য, অতিরিক্ত বিল, মিটার রিডিংয়ে অনিয়ম, আর্থিক হয়রানি এবং স্বেচ্ছাচারিতার এক করুণ চিত্র। এসবের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগে উঠে এসেছে নতুন তথ্য। ছাতকে বিদ্যুৎ বিভাগের দুর্নীতির গভীর ষড়যন্ত্র ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। ছাতক উপজেলা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (পিডিবি) বিল নিয়ে জনমনে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ এবার নতুন মাত্রা পেয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে একদল সাংবাদিক। তারা ছাতক পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মজিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন, “পোস্টপেইড যে মিটারগুলো রয়েছে, সেগুলোর মেয়াদ ২০১৮ সালেই শেষ হয়ে গেছে। ফলে অনেক মিটারে প্রকৃত রিডিং ঠিকমতো উঠছে না, কিছু মিটারে বেশি এবং কিছু মিটারে কম ইউনিট উঠছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ত্রুটিপূর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ মিটার ব্যবহারের ফলে সরকার ও সাধারণ জনগণ উভয়েই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। একদিকে কম ইউনিট উঠলে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বেশি ইউনিট উঠলে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর অযাচিত আর্থিক চাপ পড়ছে। অনেক গ্রাহক তাদের প্রকৃত ব্যবহার অপেক্ষা অনেক বেশি বিল গুণতে বাধ্য হচ্ছেন—যা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবিচারসুলভ।
এদিকে, এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ, ছাতক বিদ্যুৎ অফিসে চলছে একটি সুসংগঠিত দালালচক্রের দৌরাত্ম্য, যারা এসব ত্রুটিপূর্ণ মিটারের অজুহাতে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করছে। অথচ এই মিটারগুলো সময়মতো পরিবর্তন ও সঠিক বিলিং নিশ্চিত করা পিডিবির প্রাথমিক দায়িত্ব।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই ত্রুটিপূর্ণ মিটার ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ নিজের স্বার্থ হাসিল করছেন—এমন অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ সরকারকে বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দের অজুহাতে সরকারি সুবিধা আদায় করছেন। বাস্তবে সে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত না হলেও বিলের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক ও প্রশাসনিক সুবিধা ভোগ করছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে ছাতক পিডিবি অফিসে গড়ে উঠেছে এক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ চক্র। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিনিয়ত লিপ্ত বিল বাণিজ্য, ঘুষ গ্রহণ, হয়রানি ও প্রতারণায়। তাদের মূল লক্ষ্য—রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুটপাট করা। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে।
ভুক্তভোগীদের জোর দাবি—কেন দীর্ঘ ৬-৭ বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ মিটার পরিবর্তন করা হয়নি? কার অনুমোদনে এই অনিয়ম এতদূর গড়িয়েছে? কে বা কারা এই সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?
এছাড়া, অভিযোগ রয়েছে যে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ আমল থেকেই এই অনিয়মের বীজ বপন হয়েছিল। বর্তমান গণজাগরণ ও প্রতিবাদের সময়েও এই দুর্নীতিবাজ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। সাংবাদিকরা যখন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মজিদের কাছে দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চান, তখন তিনি অসৌজন্যমূলক ও হুমকিস্বরূপ আচরণ করেন, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
এমতাবস্থায়, ভুক্তভোগী গ্রাহক, সাংবাদিক ও সচেতন ছাতকবাসী সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নিকট আকুল আবেদন জানিয়েছেন—এই দুর্নীতির চক্র ভেঙে দিতে এবং বিদ্যুৎ অফিসকে জনবান্ধব করতে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নিরপেক্ষ তদন্ত, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এবং দালালচক্রকে নির্মূল করার জন্য প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
মিটার না দেখে বিল করার ঘটনায় হাজারো গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকৃত মিটার রিডিং না দেখে অফিস থেকেই বিল তৈরি করে পাঠানো হয়। ফলে গ্রাহকরা অতিরিক্ত বিলের বোঝা নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছেন। অনেকের বিল মিটারের রিডিংয়ের তুলনায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি আসে। প্রতিবাদ করলেই অফিসে দালালচক্রের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়।
জানা গেছে, পিডিবি অফিসে কিছু নির্দিষ্ট দালাল দীর্ঘদিন ধরে প্রকৌশলীর আশীর্বাদে গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বিল ‘ঠিকঠাক করে দেওয়ার’ নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিল সংশোধন, নাম পরিবর্তন, নতুন সংযোগ—সব কাজেই ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না বলেই দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সাংবাদিকরা যখন ভুক্তভোগীদের বিদ্যুৎ বিল, মিটার রিডিং ও অনিয়মের প্রমাণ তাকে দেখাতে চান, তখন তিনি তা দেখতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে রাগান্বিত হয়ে নিজের টেবিলে থাপ্পড় মেরে বলেন, “আমার ক্ষমতা কি জানেন? এইসব কাগজপত্র দেখিয়ে কিছু হবে না!” উপস্থিতরা এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তোমরা যা পারো করে নাও, এইসব নিউজ করে কিছুই হবে না।” অপমানজনক ভাষায় তাদের অফিস থেকে বের করে দেন।
এলাকার অন্যান্য সাংবাদিকরাও জানান, তারা তথ্য নিতে গেলে আব্দুল মজিদ তাদেরকেও অপমান করে, হুমকি দেয় এবং কোনো সহযোগিতা করে না। তার আচরণ এমন যে তিনি যেন একক কর্তৃত্ববাদী শাসন চালাচ্ছেন—কোনো নিয়ম-কানুন তার কাছে মূল্যহীন।
সচেতন মহলের প্রশ্ন—একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি জনগণের টাকায় বেতন নিয়ে জনগণকেই হয়রানি করেন, তাহলে আমরা কোথায় যাব? এমন স্বেচ্ছাচারিতা আর কতদিন চলবে? কে দেখবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার?
ভুক্তভোগী গ্রাহক, সাংবাদিক এবং সচেতন ছাতকবাসী পিডিবি কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, এই কর্মকর্তা ও তার আশ্রয়দাতা দালালচক্রকে এখনই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে ছাতক বিদ্যুৎ অফিস হয়ে উঠবে দুর্নীতির আখড়া।