স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
সরকারি বাহিনীর দ্বারা গুম হওয়া নাগরিকদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক নির্যাতন—এমন বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। নারী ও পুরুষ, কেউই রেহাই পাননি এই বর্বরতা থেকে। নির্যাতনের ধরন ছিল লোমহর্ষক ও কল্পনাতীত। সুরক্ষিত কক্ষে, কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভুক্তভোগীদের রাখা হতো অপমানজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও শারীরিক-মানসিকভাবে নিপীড়নমূলক অবস্থায়।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) গুম কমিশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটির কিছু অংশ সরবরাহ করা হয়। সেখানে উঠে আসে র্যাব, সিটিটিসি (CTTC), এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই (DGFI)-র সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত গোপন নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ।
নারীদের ওপর লাঞ্ছনার সীমা ছাড়িয়েছে
প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে গুম হওয়া ২৫ বছর বয়সী এক নারীর বর্ণনায় জানা যায়, তাকে অপহরণ করে ২৪ দিন গুম করে রাখা হয়। তিনি বলেন,
“অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ করার মতো হাত দুই পাশে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আমার গায়ে কোনো ওড়না ছিল না। জানালার দিকে মুখ করে ঝুলিয়ে রাখায় বাহিনীর সদস্যরা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে উল্লাস করছিল, কটুক্তি করছিল। তাদের হাসাহাসি আমাকে আরও বেশি অপমানিত করে তোলে।”
তিনি আরও বলেন,
“আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু আমার ওপর তারা এমনভাবে টর্চার করে যে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদের বলি যে, আমার তো প্যাড লাগবে-তখন এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করত বাহিনীর সদস্যরা।’।”
নির্যাতনের ধরন: বৈদ্যুতিক শক, ঝুলিয়ে পেটানো, নখ তুলে ফেলা
প্রতিবেদনে উল্লিখিত একাধিক ভুক্তভোগী জানান, গুম হওয়াদের শব্দনিরোধক কক্ষে রাখা হতো যাতে তাদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে না পায়। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালানোর পর ক্ষতস্থানে ওষুধ বা মলম লাগিয়ে জনসম্মুখে আনার আগে ক্ষতচিহ্ন লুকানো হতো।
৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি যিনি ৩৯১ দিন গুমে ছিলেন, জানান:
“সেলগুলো এতই ছোট ছিল যে, শুয়ে থাকলে আমাদের শরীর প্রায়শই টয়লেট প্যানের ওপর পড়ে থাকত। কোনো পর্দা ছিল না। সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে আমাদের প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্ত পর্যন্ত নজরদারিতে রাখা হতো।”
একজন বলেন,
“প্রাকৃতিক কাজ করার সময়ও পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকত, যেন আমরা কোনো মর্যাদা না পাই।”
২০১০ সালে র্যাব কর্তৃক ৪৬ দিন গুম থাকা এক যুবক বলেন,
“আমার পায়ে ক্লিপ লাগিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। কখনো গোপনাঙ্গেও লাগিয়ে শক দিত। পুরো শরীরটা ফুটবলের মতো মোচড়ানো হতো।”
আরেক ভুক্তভোগী বলেন,
“আমার আঙুলের নখ প্লাস দিয়ে তুলে ফেলা হয়।”
কমিশনের তথ্যমতে, নির্যাতনের জন্য র্যাব-২ ও সিপিসি-৩ ইউনিটে ঘূর্ণায়মান চেয়ার, শব্দনিরোধক রুম, ঝুলিয়ে রাখার পুলি-সিস্টেমসহ নির্দিষ্ট কাঠামোগত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হতো।
নারী নির্যাতনকে কেন্দ্র করে ‘উল্লাস’
একাধিক নারী ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তাদের উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখা হতো, যা পুরুষ সদস্যদের জন্য যেন এক ধরনের ‘বিনোদন’ হয়ে উঠেছিল।
“যতবারই ওরা আমার দিকে তাকাত, মনে হতো আমি একটা প্রাণী, মানুষ না। তারা উল্লাস করত, আড্ডা দিত, হাসত,”—বলেন গুমের শিকার এক নারী।
গুমের পর ‘স্বীকারোক্তি আদায়ের ফ্যাক্টরি’
ভুক্তভোগীদের কথায় জানা যায়, গুমের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। সরকারি দলের বিরোধিতা করলেই ‘সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগে গুম করা হতো। তারপর চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।
একজন বলেন,
“আমাকে বলা হয়েছিল, ‘তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব।’”
চরম অপমান, কোনো বিচার নেই
ভুক্তভোগীদের অনেকে বলেছেন,
“আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু মরার মতো জীবন। যারা আমাদের গুম করেছে, নির্যাতন করেছে, তারা এখনো প্রভাবশালী পদে বহাল। কারও বিচার হয়নি।”
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতসব নির্যাতনের পরও সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং অনেকেই এখনো পদোন্নতি পেয়েছেন।
ভবিষ্যতের শঙ্কা
কমিশনের সতর্কবার্তায় বলা হয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে এই গুম ও নির্যাতনের চর্চা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন,
“আমরা শুধু ন্যায়বিচার চাই, প্রতিশোধ নয়। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ গুম ও নির্যাতনের শিকার না হয়।”