স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে মঙ্গলবার রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভা জাতীয় রাজনীতিতে এক ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করেছে। এই সভা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একটি মঞ্চে রূপ নেয়, যেখানে ৪৫টি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করে।
ঐক্যের সুর: ভিন্নমতকে পাশে রেখেই বৃহত্তর লক্ষ্যে একতা
সভায় বক্তৃতা দেন ২১টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। তাদের বক্তব্যে ছিল ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে চলার প্রতিশ্রুতি। নেতারা বলেন, মতবিরোধ থাকলেও দেশের স্বার্থে সবাইকে একতাবদ্ধ থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই এবং যারা তা করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে জনতাই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
সমালোচনার চেয়ে আত্মসমালোচনাই বেশি
আলোচনায় এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল লক্ষণীয়—কারও বক্তব্যে সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ ছিল না। বরং দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়ার ঘাটতি, একতার প্রয়োজনীয়তা এবং রাজনীতির সংস্কার নিয়ে আত্মসমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল প্রধান।
খালেদা জিয়ার ভিডিও বার্তা: নেতৃত্বের বার্তা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিডিও বার্তা এই আয়োজনে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে। তিনি গুম-খুনের শিকারদের তালিকা প্রস্তুত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানান। একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য বজায় রাখার ওপর জোর দেন।
বক্তব্যে তিনি বলেন, “গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে ঐক্য অপরিহার্য। শহীদদের স্মরণে আমাদের দায়িত্ব তাদের পরিবারকে সম্মান দেওয়া এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা।”
তারেক রহমানের প্রস্তাব: জাতীয় সরকার ও গণভোটের প্রতিশ্রুতি
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যেও ছিল নতুন রাজনৈতিক প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতি। তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে একটি ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে তার উদাহরণভিত্তিক ব্যাখ্যা উপস্থিত নেতাদের মধ্যে আলোড়ন তোলে। অনেকেই তার এই বক্তব্যকে সাধুবাদ জানান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি: ভালো সূচনা, সামনে পথ দীর্ঘ
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, এতগুলো দলের একত্র হওয়া একটি ইতিবাচক বার্তা দেয়। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “এখনও পারস্পরিক দূরত্ব রয়ে গেছে, যা কমাতে হলে নিয়মিত সংলাপ ও বোঝাপড়ার দরকার।”
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “বহুত্ববাদী সমাজে মতপার্থক্য থাকবে, তবে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য রক্ষা করতে হবে। ভোটাধিকার, জাতীয় নির্বাচন ও গণতন্ত্রের মতো বড় প্রশ্নে সমন্বিত অবস্থান গ্রহণ জরুরি।”
অংশগ্রহণকারী দলসমূহ
আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় পার্টি (জাফর), গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, লেবার পার্টি, এনপিপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জাতীয় গণফ্রন্ট, হেফাজতে ইসলামসহ ৪৫টি রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, “এই সভায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐকমত্যে। শহীদ পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে, তাদের খোঁজখবর নেওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র তারেক রহমানই পাশে দাঁড়িয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “বিএনপি দলীয় আদর্শ ছাড়িয়ে গিয়ে সবাইকে নিয়ে একত্রে কাজ করার জন্য উদার মনোভাব দেখিয়েছে। আগের দিনে কিছু ধর্মভিত্তিক দল বিএনপিকে উপেক্ষা করলেও, এবার বিএনপি সকল ফ্যাসিবাদবিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে—এটা দলের মহানুভবতার দৃষ্টান্ত।”