পিআর পদ্ধতির নামে ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না, প্রশ্ন রাজনীতিতে

স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:

 

জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব ঘিরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তত্ত্বাবধানে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংসদের উচ্চকক্ষে এই পদ্ধতি প্রবর্তনের আলোচনা হলেও এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য এখনও অধরা।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বিরোধিতা, ছোট দলের আগ্রহ

বিএনপি ও এর সমমনা ছয়টি দল এবং জোট পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, এই প্রস্তাব বিভাজনমূলক ও অনৈতিকভাবে নির্বাচন পেছানোর কৌশল হতে পারে। অন্যদিকে এনসিপি, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্যসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে। জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে, তারা সংসদের দুই কক্ষেই এই পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছে।

সংলাপ দরকার বলে মত ঐকমত্য কমিশনের

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন, প্রাথমিক আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। তাই বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর আলোচনার প্রয়োজন। তিনি বলেন, “এটি একটি মৌলিক বিষয়, এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা ঠিক হবে না।”

বর্তমান ব্যবস্থা বনাম প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতি

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (FPTP) পদ্ধতিতে নির্বাচনে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন। বিপরীতে সংখ্যানুপাতিক (PR) পদ্ধতিতে দলীয় প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদীয় আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, কোনো দল ১০ শতাংশ ভোট পেলে, তারা ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পাবে।

সংসদের দ্বিকক্ষ প্রস্তাব ও পিআর পদ্ধতি

২৯ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ একীভূত করে সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব রাখা হয়। প্রস্তাবে নিম্নকক্ষে সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধি বহাল রেখে উচ্চকক্ষে ১০০টি আসন দলীয় ভোটের অনুপাতে মনোনীত করার সুপারিশ করা হয়।

উচ্চকক্ষের সদস্যরা অর্থবিল ছাড়া সব আইন নিয়ে পর্যালোচনা ও মতামত দিতে পারবেন। সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তা ও যুদ্ধ ঘোষণার মতো ইস্যুতে নিম্নকক্ষের সঙ্গে উচ্চকক্ষেরও অনুমোদন প্রয়োজন হবে।

নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সরাসরি নির্বাচন হবে শুধু নারী প্রার্থীদের মধ্যে।

বিএনপির আপত্তি: বিভাজন ও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের আশঙ্কা

১ জুলাই বিএনপির ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ ও অস্থিতিশীল সরকার তৈরির আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রস্তাবের আড়ালে দেশে আবার ফ্যাসিস্ট রাজনীতির জায়গা তৈরি হচ্ছে কি না, তা ভেবে দেখা জরুরি।”

তার এ বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও লেবার পার্টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।

ছোট দলগুলোর মত: ‘উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ছাড়া পিআর অর্থহীন’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “নিম্নকক্ষের অনুপাতে যদি উচ্চকক্ষ গঠিত হয়, তাহলে সেটা কেবল তার অনুলিপি হয়ে দাঁড়াবে।” এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “উচ্চকক্ষের নিজস্ব ক্ষমতা না থাকলে সেটি অর্থহীন। নিম্নকক্ষের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন করলে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে।”

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামী আন্দোলন দুই কক্ষেই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চালুর পক্ষে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি: সংস্কার থমকে যেতে পারে

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মো. আব্দুল আলীম মনে করেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আটকে যাবে। তিনি বলেন, “নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় ৯০টি দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু রয়েছে। এতে ভোট অপচয় কম হয় এবং দলগুলোর জবাবদিহিতা বাড়ে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে এবং ঐকমত্য না থাকলে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন কঠিন হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *