জুলাই ঘোষণাপত্রে সংশোধনী নিয়ে ইতিবাচক অবস্থানে বিএনপি

স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:

 

জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র তৈরির লক্ষ্যে সরকার ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে দেশের বৃহত্তম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছে খসড়া প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বিএনপি ইতোমধ্যে এই খসড়া ঘোষণাপত্র পর্যালোচনা শেষে কিছু সংযোজন-বিয়োজনসহ নিজেদের মতামত চূড়ান্ত করেছে। খুব শিগগিরই তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী

গণ-অভ্যুত্থানের ভাবনা ধারণে বিএনপি শুরু থেকেই সহমত পোষণ করলেও সংবিধান পুনর্লিখনের বিরুদ্ধে তারা শুরু থেকেই অবস্থান নিয়েছে। দলটি মনে করে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অবদানকেও এই ঘোষণায় গুরুত্ব দিয়ে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব করেছে দলটি।

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দুই দফা বৈঠকে খসড়াটি বিস্তারিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে বিএনপি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও নতুন সংযোজন

নতুন খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের উত্তরণ, ১/১১-এর ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগ সরকারের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে।

তাতে বলা হয়—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান আন্দোলন, ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সৈনিক-জনতার বিপ্লব, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা—সবই বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে দমন-পীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে দমন এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলো শেখ হাসিনার একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছে।

২০২৪ সালের গণ-আন্দোলন নিয়ে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, জনগণের বিক্ষোভ এক সময় গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এই সময়ে সংঘটিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং সম্পদের লুটপাটের সুষ্ঠু বিচার হবে বলে ঘোষণাপত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

সংস্কার ও বৈদেশিক বাণিজ্য ইস্যু

গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আরও কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ। বিএনপি এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।

এছাড়া সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যেসব আলোচনা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হয়। তবে বিএনপি নারীদের নির্বাচনের পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে এবং পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপভিত্তিক রিপোর্ট উপস্থাপন করেন এবং সংস্কারের বিষয়ে নেতাদের মতামত নেন। বৈঠকে নেতারা বলেন, যেসব বিষয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব।

জুলাই ঘোষণাপত্রের পটভূমি ও ছাত্র আন্দোলন

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্রথমবারের মতো ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ঘোষণা দেয়। এরপর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করা হলেও ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব জানিয়ে দেন, সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

পরবর্তীতে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালিত হয় এবং ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সরকার সময়মতো খসড়া দিলেও ঐকমত্য গড়ে না ওঠায় তা স্থগিত থাকে।

পরবর্তীতে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ৩০ কর্মদিবসের আলটিমেটাম দিয়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার পর তারা ৩ আগস্ট নিজেরাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয়।

আগামীর পদক্ষেপ

বর্তমানে সরকারের প্রস্তুতকৃত ঘোষণাপত্রের খসড়া পর্যায়ক্রমে সব ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হচ্ছে। বিএনপির সংশোধনী যুক্ত করে খসড়ার একটি চূড়ান্ত সংস্করণ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানানো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *