স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
পিরোজপুরে বিএনপির রাজনীতি আজ প্রশ্নবিদ্ধ এক ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে। তিনি সরোয়ার হোসেন—পৌর বিএনপির সদস্য সচিব। তৃণমূলের কেউ কেউ তাকে বলেন “আওয়ামীপন্থী বিএনপি নেতা”। তার আচরণ, রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক উত্থান এবং প্রভাব বিস্তারের ধরণে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
সরোয়ার হোসেনের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন সাবেক টোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও তার অবাধ চলাফেরা, দলীয় প্রভাব এবং সুবিধা গ্রহণের বিষয়টি কারও অজানা নয়। রাজনৈতিক সমীকরণে সরোয়ার তার ভাইকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিলেন, আর বর্তমানে তার ভাই আনোয়ার রাজনৈতিক প্রতিদানে সরোয়ারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছেন।
সরোয়ারের প্রভাব শুধু নিজের অবস্থানে সীমাবদ্ধ নয়। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী নেতা, সাবেক ভিপি এস এম বাইজিদ হোসেন বর্তমানে একাধিক মামলায় পলাতক। জানা গেছে, বাইজিদের যত ঠিকাদারি ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সরোয়ার তা দেখভাল করেন। এমনকি নির্বাচনী মিটিং-মিছিলেও বাইজিদের লোকজন ব্যবহার করেছেন সরোয়ার। অর্থাৎ, শুধু দলের ভিতর নয়, বাইরের মাফিয়া সিন্ডিকেটেও রয়েছে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা।
সাবেক ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে সরোয়ার হোসেন বরাবরই জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষ করে পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমানের একান্ত অনুসারী ছিলেন তিনি। অথচ, বিএনপির পদধারী হয়েও আওয়ামী সরকারের আমলে তিনি যে বহাল তবিয়তে প্রকাশ্যে চলাফেরা করেছেন, তা দেখে অনেকেই বিস্মিত হন।
এক সময় সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া সরোয়ার চলাফেরা করতেন রেন্ট-এ-কার মোটরসাইকেলে। অথচ বর্তমানে তার বাহন এক্স-নোয়া স্কোয়ার গাড়ি—যা বলে জানা গেছে সাবেক এক প্রভাবশালী আওয়ামী এমপি তাকে উপহার দিয়েছেন। বিনিময়ে সরোয়ার আওয়ামী ঘরানার কর্মীদের সুবিধা দেবেন—এমন অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী জানিয়েছেন, হুলারহাটের কচা নদীতে রাতের আঁধারে চোরাচালান সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন সরোয়ার হোসেন। তার আচরণ, অর্থনৈতিক উত্থান এবং প্রভাবশালী যোগাযোগ এক রাতেই বদলে গেছে বলে মন্তব্য করেন অনেকে—”আঙুল ফুলে কলাগাছ, গোরে পদ্মফুল!”
গত ৬ জুলাই পিরোজপুর পৌর বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একাধিক প্রার্থী ও নেতাকর্মীর অভিযোগের ভিত্তিতে তা স্থগিত করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, সরোয়ার নিজেই কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায় করে এবং নির্দিষ্ট লোকদের প্রার্থিতায় অর্থ দিয়ে কাউন্সিলকে প্রভাবিত করেন। এতে ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে তার প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
বিশেষ করে ১ নম্বর ওয়ার্ডের ত্যাগী নেতা রুহুল আমিনকে ফরম কিনতে বাধা দেওয়া হয়। এতে তৃণমূলে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা জালাল ফকির দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার। আওয়ামী লীগের সময় রাজনৈতিক মামলার আসামি হয়েও দল থেকে সরে যাননি। অথচ এবারের কাউন্সিলে তাকে শুধুমাত্র একটি আওয়ামী নেতার সঙ্গে পুরনো ছবি থাকার অজুহাতে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়।
তৃণমূল প্রশ্ন রাখছে—একজন ‘ছবি’র কারণে বাদ, কিন্তু সরোয়ার, যিনি একাধিক প্রভাবশালী আওয়ামী নেতার ছায়ায় থাকেন, গাড়ি উপহার পান, তাদের সঙ্গে রাজনীতি করেন—তাকে সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে দেওয়া হয় কীভাবে?
বহু ত্যাগী ও নির্যাতিত বিএনপি নেতাকর্মীর অভিযোগ—সরোয়ারের মতো বিতর্কিত, দুর্নীতিপরায়ণ নেতাকে পকেট কমিটি করে উপরে তুলে আনা হলে সংগঠন ধ্বংসের মুখে পড়বে। তারা তদন্ত করে সরোয়ারের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বচ্ছ ভোটার তালিকার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন।
সরোয়ার হোসেনের রাজনীতি কি শুধুই আদর্শনির্ভর, নাকি সুবিধাভোগের কৌশল? তার রাজনৈতিক মুখোশ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পিরোজপুর বিএনপির ভবিষ্যৎকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে দলের উচ্চপর্যায়ের তৎপরতা ও সঠিক সিদ্ধান্তই কেবল সংগঠনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে।