তথ্যপ্রযুক্তির জোয়ারে পপ সংস্কৃতির আগ্রাসন, হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার লোকগীতি ও সংস্কৃতির শিকড়

মোঃ আরফাতুল ইসলাম:

নাচ ও গান—শুধু বিনোদন নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রতিটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে, যেখানে গান ও নাচ বহন করে ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং চেতনাকে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায়, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ও সংস্কৃতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে তথাকথিত ‘পপ’ সংস্কৃতি।

পপ সংস্কৃতির চটুলতা বনাম লোকগীতির শিকড়

পপ গান বা পপ নাচ—একদিকে বিনোদনের বাহন, অন্যদিকে সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে একধরনের অস্থিরতা ও ভোগবাদী মনোভাব। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আজকের তরুণ প্রজন্ম ঝুঁকে পড়েছে বিদেশি ধাঁচের নাচ ও গানের দিকে। টিকটক, রিলস, ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম—সবখানে চলছে শরীর দেখানো, অঙ্গভঙ্গির নৃত্য। সাময়িক করতালি ও কিছু ভিউয়ের মোহে হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংগীত, হারাচ্ছে আত্মপরিচয়।

একজন অভিভাবক হিসেবে আমাদের নিজেকেই প্রশ্ন করা উচিত—এই পপ সংস্কৃতি কি সত্যিই আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে? নাকি তাদের নামিয়ে দিচ্ছে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে?

পপ গানের উল্লম্ফনে দেশীয় সংগীতের করুণ দশা

বাড়ির উঠোনে একতারা, ঢোল, হারমোনিয়ামের সুর এখন যেন শুধুই স্মৃতি। বটবৃক্ষের ছায়ায় ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, কবিগান কিংবা পালাগান—এসব আজ শুধু বিশেষ দিবসের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। অথচ এগুলোতেই ছিল আমাদের শিকড়ের টান, ইতিহাসের ঝলক, আর দেশপ্রেমের স্পর্শ।

এক সময় গ্রামীণ বিয়েতে, উৎসবে, এমনকি শীতের রাতেও দল বেঁধে যাত্রাপালা বা কবিগান হতো। তরুণ-তরুণীরা অংশ নিত সেসব পরিবেশনায়, শিক্ষার্থী-শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়তেন দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায়। এখন সেই জায়গায় জায়গা করে নিয়েছে ‘ডিজে’র প্যাকেজ অনুষ্ঠান, যেখানে চলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে পোশাক ও অঙ্গভঙ্গি।

তথ্যপ্রযুক্তির সুফল আছে, কুফলও অগণিত

তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই সুবিধার চাপে যদি সংস্কৃতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে, তাহলে তা আত্মঘাতী। মোবাইল, ইন্টারনেট এখন শুধু শেখানোর নয়, বিভ্রান্তির মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বেহায়াপনা, বিকৃতি, দ্রুতবিলাসী জীবনের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেকে হারাচ্ছে নিজেকে—মানসিক ও নৈতিকভাবে।

স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জেসমিন আরজু এক পর্যবেক্ষণে বলেন,

“পপ গানের তালে আমাদের সন্তানরা টিকটকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে ভিডিও বানিয়ে যেন দেশীয় সংস্কৃতিকে ভুলে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশপ্রেম ও সংস্কৃতি বিষয়ে পাঠদান ও অনুশীলনের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার।”

সমাধান: শিকড়ে ফিরে যাওয়া ও সচেতন সমাজ গঠন

আমরা যদি সত্যিই আমাদের সন্তানদের জন্য একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ চাই, তাহলে এখনই সময় সচেতন হওয়ার। নাচ-গানের বিরুদ্ধে নয়, বরং বেলেল্লাপনা ও বিকৃত রুচির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সময় এসেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে দেশীয় সংগীত, অঞ্চলভিত্তিক গান এবং ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে।
বাঙালির অন্তরে পুনরায় জেগে উঠুক লোকগীতি, দেশপ্রেম, এবং আত্মমর্যাদার শিক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *