যাদুকাটা নদীর বালি নিয়ে দেন দরবার চলছে পুলিশ বনাম আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে

মো: ইসলাম উদ্দিন তালুকদার:

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের সামনে যাদুকাটা নদীর বালু লুটের খবর সেনাবাহিনীকে জানানোর কারণে তাহিরপুর থানার ওসি উপজেলা কৃষকদল নেতাকে মোবাইল ফোন দিয়ে বললেন, ‘তোমার কেমন সাহস, তুমি কত বড় ডাকাইত, ফেসবুকে কী লিখেছো, আমি কাল তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে উপজেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক তানিম আহমেদ লিংকনকে এভাবেই গালিগালাজসহ হুমকি দেন তাহিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। ক্ষুব্ধ ওসির এমন হুমকির জবাব ঠান্ডা মাথায় দেবার চেষ্টা করছিলেন কৃষকদল নেতা লিংকন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি তো আপনার বিরুদ্ধে কিছু লিখিনি, আপনি আমাকে ডাকাত বলছেন কেন।’

তাহিরপুর থানার ওসি ও লিংকনের এই কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয় শনিবার (১২ জুলাই) সকাল থেকেই। লিংকন জানান, তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীর কোটি কোটি টাকার বালু লুটপাটের তথ্য শুক্রবার জেলার সেনা ক্যাম্পের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে জানান তিনি। তিনি সেনাবাহিনীকে জানান, প্রতিদিন রাতে অসংখ্য বালু ভর্তি বাল্কহেড তাদের বাড়ির পাশের (উজান তাহিরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে) বৌলাই নদী দিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গুরুত্ব দিয়ে তার অভিযোগ লিখে রাখা হয়।

সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কোথায় সরেজমিনে গেলে এই লুটপাটের চিত্র দেখা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন তাহিরপুরের বাদাঘাটের লাউড়েরগড় থেকে আনোয়ারপুরের ফাজিলপুরের বৌলাই নদীর মুখ পর্যন্ত এই চিত্র দেখা যায়। এই তথ্য জানানোর পর বৃহস্পতিবার রাত দুইটায় তাহিরপুর থানার ওসি তাকে (লিংকনকে) গালিগালাজ করেন। হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তুমি তো বালু লুটপাট কর, তোমাকে থানায় আনার জন্য বলেছে।’

তিনি জানান, ওসি ধমক দেবার পরে তার নিজের (লিংকনের) ফেসবুক আইডি থেকে শুক্রবার সকাল থেকে যাদুকাটা নদী থেকে বালু লুটপাট নিয়ে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাত দুইটায় স্ট্যাটাস দেন তিনি। এই স্ট্যাটাসে শুক্রবার দুপুরে যাদুকাটার পাড়ের শিমুল বাগানে বালু লুটপাটের ঘটনায় মারামারি এবং একই সময়ে বালিজুরিতে বালুসহ বাল্কহেড স্থানীয় জনতা কর্তৃক আটকের কথা উল্লেখ করেন। এরপর রাত সাড়ে তিনটায় আবার থানার ওসি তাকে ফোন দিয়ে গালিগালাজ করেন।

দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর পত্রিকার প্রতিবেদককে লিংকন বলেন, আমাকে এমনভাবে ওসি সাহেব গালিগালাজ করেছেন, যা আমি সহ্য করতে পারিনি। এক পর্যায়ে সকলকে জানানোর জন্য এই গালিগালাজের কিছু অংশ রেকর্ড করে ফেসবুকে ছাড়েন তিনি।

তাহিরপুর উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি বালিজুরির বাসিন্দা ফেরদৌস আলম বললেন, যাদুকাটা ইজারাবিহীন থাকলেও সাবেক ইজারাদারের কিছু প্রভাবশালী অংশীদাররা লুটপাট ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে অবৈধভাবে বহন করা বালুবাহী বাল্কহেড আটক করে পুলিশকে খবর দেন তারা, পুলিশও পরদিন শুক্রবার অনেক বিলম্বে আসে। শুক্রবার সকালে বাল্কহেডের শ্রমিকরা জানিয়েছে, এই বালু তাহিরপুরের সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আফতাব উদ্দিনসহ কয়েকজনের। পরে পুলিশ বালু ভর্তি নৌকা জব্দ করে। নৌকার ৩ শ্রমিককেও আটক করে। তিনি বলেন, যাদুকাটায় বালু লুটপাট যেহেতু দেদারসে চলছে, এ নিয়ে কেউ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নালিশ করলে দোষের কিছু দেখছি না।

এই বিষয়ে কথা বলার জন্য সাবেক উপজেলা পরিষদ আফতাব উদ্দিনের ব্যবহৃত দুইটি মুঠোফোনে চেষ্টা করা হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু তার ফোন বন্ধ থাকায় কথা বলা যায়নি। পরে ম্যাসেজ পাঠালেও কোন সাড়া মেলেনি।

তাহিরপুরের ওসি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বললেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের চেষ্টা করছে বিএনপি নেতা তানিম আহমেদ লিংকনও। ব্যর্থ হয়ে সে আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে নদীর তীরের বালি শ্রমিকরা বলেন, প্রতিরাতে শিমুল বাগানের নিকটে সরকারি খাস খতিয়ানের জায়গা থেকে আফতাব উদ্দিন ও তার বড় ভাই বিএনপি নেতা রাখাব উদ্দিনের ছত্রছায়ায় নদীর পাড় কাটা এবং বালিচুরির মহোৎসব চলছে। নৌপুলিশের দারোগা এবং তাহিরপুরের ওসি দেলোয়ার হোসেনের সাথে তাদের দহরম-মহরম থাকায় ধরপাকড় অভিযান ও মামলা মোকদ্দমা থেকে তাদেরকে আড়াল করা হয়।

এলাকাবাসী বলেন, রাখাব উদ্দিন এর বাবা প্রয়াত জয়নাল আবেদীন আমৃত্যু বাদাঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তার আপন ভাই নিজাম উদ্দিন তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য পদে রয়েছেন। তারা ৬ ভাইয়ের মধ্যে ৫ ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছেন। রাখাব উদ্দিন ১৯৯৭-৯৮ সালে জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। আপন বোন সেলিনা আবেদীন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

একই অঙ্গে বহুরুপের অধিকারী রাখাব উদ্দিন বাদাঘাট বাজারে আগত প্রতি বস্তা ইন্ডিয়ান ফুসকা থেকে ১০০ টাকা হারে, বাদাঘাট বাজারে মালবাহী ট্রাক প্রবেশ করলে প্রতি ট্রাক থেকে ১০০ টাকা হারে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করতেন রাখাব উদ্দিন ও তার বাহিনীর লোকজন। বর্তমানে ফুসকা ব্যবসা বন্ধ থাকলেও তারা দুই ভাইয়ের ড্রেজার চলছে দেদারছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *