ইসলাম উদ্দিন তালুকদার:
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)-এর কনসালটেন্ট আবু ফাত্তাহ ও প্রধান প্রকৌশলীর সহকারী আব্দুল মান্নান অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র। এই দুজন মিলে প্রধান প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছে নানান দুর্নীতি ও অনিয়ম। সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল মান্নানের রয়েছে অগাৎ সম্পত্তি। কনসালটেন্ট আবু ফাত্তাহ’র সাথে রয়েছে গভীর সুসম্পর্ক। আবু ফাত্তাহ’র জীবনযাত্রা ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের কাহিনি শুনলে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না। নিজেকে ‘মিডিয়া কনসালটেন্ট’ পরিচয় দিলেও তার চাকরির ভিত্তি একটি নকল সনদপত্র। আয় ও সম্পদের মধ্যে বিরাট অমিল লক্ষ করা যায়। ঢাকার মোহাম্মদপুরে কোটি টাকার ফ্ল্যাট, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় চারতলা ভবন, বিস্তৃত জমির মালিক হওয়া—সবই হয়েছে অবৈধ আয়ের মাধ্যমে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি ভুয়া সনদপত্র ব্যবহার করে এলজিইডিতে দ্বিতীয় শ্রেণির কনসালটেন্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন। অল্প সময়ে তার আর্থিক উন্নতির গতি দেখে সহজেই বোঝা যায় যে তার দুর্নীতির পরিমাণ কতটা ব্যাপক।
বর্তমানে এলজিইডিতে ‘ত্রিশূল’ নামে একটি চক্রের প্রভাব বিস্তার করেছে। এর এক প্রান্তে রয়েছেন আবু ফাত্তাহ, অন্য প্রান্তে প্রশাসনিক শাখায় কর্মরত একজন উচ্চমান সহকারী, আরেক প্রান্তে সিরাজগঞ্জে কর্মরত একজন কর্মকর্তা, যিনি বাস্তবে ঢাকায় এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এই চক্রের মাধ্যমে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব বিস্তার করে ঘুষ ও দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে।
আজকের পর্বে এই ‘ত্রিশূল’-এর এক সদস্য আবু ফাত্তাহর সম্পদ ও দুর্নীতির কাহিনি তুলে ধরা হলো, পরবর্তী পর্বে বাকি দুই সদস্যকে নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
কর্মজীবনের সূচনা:
আবু ফাত্তাহ এলজিইডিতে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কনসালটেন্ট পার্টে যোগ দেন। এই পদে চাকরি করতে হলে যেই শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন, তা তার ছিল না। জানা যায়, তিনি বি.এ. পাসের একটি ভুয়া সনদপত্র তৈরি করে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে চাকরি শুরু করেন, তবে কিছুদিন পরই তাকে সেখান থেকে বরখাস্ত করা হয়।
পরবর্তীতে এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান এবং পিডি কাজী খুরশিদ হাসানের আশীর্বাদে আবু ফাত্তাহ এলজিইডিতে নিয়োগ পান। তখন থেকেই তিনি নিজেকে “মিডিয়া কনসালটেন্ট” বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন, যদিও এলজিইডির নিয়মিত জনবল কাঠামোতে এমন কোনো পদ নেই। কয়েকটি প্রকল্পে ওই নামের পদ থাকলেও, ফাত্তাহ সেসব প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন না। বরং বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে এই পদবি ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন।
নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন:
আবু ফাত্তাহর দুর্নীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। ওয়াহিদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সময়ে প্রায় ছয় হাজার কর্মচারীর চাকরি স্থায়ীকরণের আদেশ আসে আদালত থেকে। এর সুযোগ নিয়ে ফাত্তাহ ও তার সঙ্গীরা গড়ে তোলেন বিশাল ঘুষ বাণিজ্য। সূত্র অনুযায়ী, পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে প্রায় ৩১০০ জনের কাছ থেকে তিনশ কোটি টাকারও বেশি আদায় করা হয়।
এই সময় নির্বাহী প্রকৌশলী প্রশাসন আব্দুস সাত্তার, সহকারী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম মন্ডল এবং আবু ফাত্তাহ এই তিনজন মিলে বাণিজ্য চালান। এখান থেকেই মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে ফাত্তাহ উল্লাপাড়ায় কয়েক একর জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। আবদুর রশিদ খানের সময়ও ফাত্তাহ ঘুষের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ে শতাধিক কর্মচারীর চাকরি দেন। সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব মোর্শেদ শাহিনের সহায়তায় এসব নিয়োগ সম্পন্ন হয়।
এই নিয়োগেও পদভেদে চার লাখ থেকে শুরু করে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হতো। ফাত্তাহ তার অংশের টাকায় মোহাম্মদপুরে দেড় হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনে বসবাস শুরু করেন। পরে ২০ লাখ টাকা খরচ করে সেটির অভ্যন্তরীণ সজ্জাও করান।
অভ্যন্তরীণ চক্রের দৌরাত্ম্য:
আবু ফাত্তাহর সাথে এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা যেমন জহিরুল ইসলাম মন্ডল, আব্দুস সাত্তার এবং মাহবুব মোর্শেদ শাহিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই কর্মকর্তারা ঘুষ আদানে তাকে সহায়তা করতেন এবং লেনদেন ভাগ করে নিতেন। এর মাধ্যমে এলজিইডিতে এক ধরনের দুর্নীতির নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।
দুদকের ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায়:
ফাত্তাহর নৈপুণ্য এখানেই শেষ নয়। জানা গেছে, দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতারুল ইসলামের সঙ্গে তার সখ্যতা দীর্ঘদিনের। কোনো পিডি বা প্রকৌশলী তার কথায় কর্ণপাত না করলে, তিনি বেনামি অভিযোগ পাঠিয়ে সেই কর্মকর্তার নামে তদন্ত চিঠি আনাতেন। পরে নিজেই সেই পিডিকে গিয়ে জানান যে তিনি দুদকের সাথে সমঝোতা করে সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন। এভাবে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করতেন।
সাংবাদিকদের ম্যানেজ ও ব্ল্যাকমেইল কৌশল:
ফাত্তাহর আরেকটি ‘অস্ত্র’ হলো “সত্য সমাচার” নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। তার আওতাধীন কিছু কথিত সাংবাদিক বিভিন্ন প্রকল্পের পিডিদের নামে ভিত্তিহীন সংবাদ তৈরি করে, তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে এবং পরে সংবাদ না ছাপানোর নামে ঘুষ আদায় করে। এসব সাংবাদিক প্রকল্প অফিসে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তাদের পেছনে থেকেই ফাত্তাহ পুরো নাটকটি পরিচালনা করেন।
নকল সনদপত্র ও অবৈধ নিয়োগ:
আবু ফাত্তাহ এইচএসসি পাশ। পরিবারের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত। তার এক ভাই এসএসসি পাশের ভুয়া সনদপত্র ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ে অফিস পিয়ন পদে চাকরি পেয়েছেন। জানা যায়, ফাত্তাহ নিজে ভুয়া বি.এ. সনদপত্র দিয়ে ইত্তেফাকে কাজ শুরু করেছিলেন এবং পরে এলজিইডিতে ঢোকেন। তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান তার অনুগতদের এলজিইডি থেকে সরিয়ে দিয়ে ফাত্তাহকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান।
নকল সনদপত্র ব্যবহার করে চাকরি পাওয়া এবং তারপর সেই পদের অপব্যবহার করে দুর্নীতি করার বিষয়ে এলজিইডির মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। অনেকে চাইছেন, তার সনদপত্র যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং প্রমাণ হলে তার প্রাপ্ত বেতন সরকারকে ফেরত দিতে বাধ্য করা হোক।
শেষ কথা:
আবু ফাত্তাহর নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, নকল সনদপত্র ব্যবহার, সাংবাদিক ম্যানেজমেন্ট, এবং এলজিইডিতে ‘ত্রিশূল’ গোষ্ঠীর প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় পর্বে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হবে।