ওয়াহিদ হোসেন:
স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মুন্সী মো. হাচানুজ্জামানের বিরুদ্ধে উঠেছে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ।
লক্ষ্যহীন প্রকল্প, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতা
২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়া এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ৫২টি ল্যাব স্থাপন করা হয়। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল এসব ল্যাবে জনবল নিয়োগ দিয়ে পানি পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করা। কিন্তু প্রকল্প শেষে এসেও ৩২২ জন জনবল নিয়োগ হয়নি। ফলে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। অথচ পিডি হাচানুজ্জামান এই প্রকল্পের পুরোদস্তুর নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
লক্ষ্যে ব্যর্থ, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পদে সফল
প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলেও ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এই পিডি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়েছে, তার দুই স্ত্রী এবং তাদের পরিবারের নামে রাজধানী ও বিভিন্ন জেলায় রয়েছে কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। ফরিদপুরের মধুখালীতে রয়েছে তার আলিশান বাড়ি ও চারতলা মার্কেট।
অগ্রিম বিল, ঘুষ ও টেন্ডার কারসাজি
টেন্ডার আইডি ৯১৩০৪৭ অনুযায়ী, সাত কোটি টাকার গ্লাস ওয়্যারস ও কেমিক্যাল সরবরাহের চুক্তি হয় মার্কস ট্রেডিং লিমিটেডের সঙ্গে। কিন্তু কোনো মালামাল বুঝে না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয় পাঁচ কোটি ৮০ লাখ টাকার বিল। অভিযোগ অনুযায়ী, এই বিলের অংশ হিসেবে পিডি হাচানুজ্জামান নগদ দুই কোটি টাকা ঘুষ নেন। এই অনিয়মের তদন্তে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, তারা কোনো তথ্যই জানেন না।
‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ’ নামেই ঘুষ
প্রকল্পের প্রায় সব কেনাকাটায় ৫–৬% ঘুষ নেওয়া হতো। ঠিকাদারদের কাছে দাবি করা হতো—”ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই টাকা দিতে হবে।” হাচানুজ্জামান নাকি প্রায়ই বলেন, “আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না, সবাইকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছি।”
ভুয়া কোটেশন ও জাল স্বাক্ষরে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ
রূপম ট্রেডার্স, নাদিম ইকবাল ও রাজ ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে ভুয়া কোটেশন তৈরি করে তিনি টেন্ডার ছাড়াই দুই কোটি টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। সাবেক পিয়ন ইমন, নারী কর্মচারী নার্গিস এবং নিজের চাচাতো ভাই সিমোনকে দিয়ে এসব কোটেশন প্রস্তুত করে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেন।
পিয়নের চাকরি দিয়ে ভাইয়ের হাতে দুর্নীতির লাগাম
প্রকল্পের অফিসিয়াল পিয়নকে বাদ দিয়ে নিজের চাচাতো ভাই সিমোনকে মাস্টার রোলে পিয়ন হিসেবে নিয়োগ দেন পিডি হাচানুজ্জামান। তিনি তার গাড়ি ও আর্থিক লেনদেনের দায়িত্বও দেন এই ভাইকে। পরিবার ও আত্মীয়দের নামে রয়েছে শত শত বিঘা জমি, ব্যাংকে জমা কোটি কোটি টাকা।
পরিবারের নামে সম্পত্তির পাহাড়
ফরিদপুরের গোয়ালচামটে বড় স্ত্রী শাহানাজ বেগমের নামে রয়েছে ‘পরিচর্যা হাসপাতাল লিমিটেড’। ছোট স্ত্রী সুমাইয়া আক্তারের নামে রয়েছে পূর্বাচলের ডুপ্লেক্স সিটিতে পাঁচ কাঠার প্লট। মিরপুর ৬০ ফিটে নয়তলা ভবন ও নবীনগর ডিওএইচএসে সাড়ে নয়তলা ভবন ইতিমধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
অডিট আপত্তি, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেই
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটি ঘিরে একাধিক সুপারিশ দেয়। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি অডিট আপত্তি থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখনো কার্যকর তদন্তে নামেনি।
পিডির দাবি: সবই মিথ্যা
এই সব অভিযোগের জবাবে পিডি হাচানুজ্জামান বলেন, “সবই মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ।” তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
বিশেষজ্ঞের মত
ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, “প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। কিন্তু দুদক চুপ করে বসে থাকে। তারা যেন বিরোধী দমন কমিশনে পরিণত হয়েছে। এই ধরনের কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে দুর্নীতি থামানো সম্ভব নয়।”
শেষ কথা
একজন পিডির ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির এমন নির্লজ্জ উদাহরণ দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য বড় পরীক্ষা। তদন্ত, আইনানুগ ব্যবস্থা ও সম্পদের উৎস খতিয়ে না দেখলে জনগণের করের টাকাই প্রতারণার পাত্রে ঢালা হবে।