বরিশালে রাজনৈতিক সহিংসতায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার মর্মান্তিক মৃত্যু

বরিশাল প্রতিনিধি: 

বরিশালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন সিকদার (৪২) নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) নগরীর কাশিপুর বিল্ববাড়ী এলাকায় নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হামলায় তিনি নিহত হন। হামলাকারীরা কুপিয়ে লিটনের শরীর থেকে ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আহত অবস্থায় তাকে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পারিবারিক বিরোধ থেকে রক্তাক্ত সংঘর্ষ

নিহতের পরিবার দাবি করেছে, লিটনের বোন মুন্নি সিকদারের স্বামী জাকির হোসেন ও তার পক্ষের লোকজনই এই হামলার জন্য দায়ী। পারিবারিক বিরোধের সূত্রপাত হয় জাকিরের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে। লিটনের বোন মুন্নি জানান, “ঢাকায় আরেকটি বিয়ে করার পর থেকেই জাকির প্রায়ই আমাকে নির্যাতন করত। আমার ভাই লিটন এতে প্রতিবাদ করলে উত্তেজনা বাড়ে।”

স্থানীয়রা জানান, বিরোধ চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। প্রায় ১০-১২ দিন আগে লিটন তার ভগিনীপতি জাকিরকে ঘরে আটকে মারধর করেন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে এবং এ ঘটনায় লিটনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। বৃহস্পতিবার জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরার পরপরই হামলার ঘটনা ঘটে।

৪০-৫০ জনের সংঘবদ্ধ হামলা: পুলিশের উপস্থিতি ও নীরবতা

ঘটনার সময় স্থানীয় বিমানবন্দর থানার এসআই শহিদুলের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। হামলার আগেই লিটনের পরিবারের পক্ষ থেকে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা জানিয়ে থানায় খবর দেওয়া হয়। এরপর এসআই শহিদুল ঘটনাস্থলে যান।

তবে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের উপস্থিতিতে হামলাকারীরা লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে লিটনের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ভিডিওতে স্থানীয় এক বাসিন্দাকে এসআই শহিদুলকে সতর্ক করে বলতে শোনা যায়, “লিটনরে সরান, না হইলে মাইরা ফালাইবো।” কিন্তু এরপরও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সরে যায় বলে অভিযোগ। ভিডিওতে আরও শোনা যায়, একজন হামলাকারী বলছে, “লিটনরে শ্যাষ কইরা দে।”

নিহতের পরিবারের ক্ষোভ ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিটনের বোন মুন্নি বলেন, “আমার ভাই পুলিশের সামনেই খুন হলো। তারা চাইলে তাকে রক্ষা করতে পারত। কিন্তু তারা কিছুই করেনি।” এ ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।

নিহতের মা রাবেয়া বেগম (৫৮), বোন মুন্নিসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

পুলিশের ব্যাখ্যা

ঘটনার বিষয়ে কথা বলার জন্য এসআই শহিদুলকে একাধিকবার ফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিমানবন্দর থানার ওসি জাকির হোসেন সিকদার গণমাধ্যমকে বলেন, “শহিদুল তদন্তের জন্য সেখানে গিয়েছিল। তখনো হামলা শুরু হয়নি। পরে সংঘর্ষের খবর পেয়ে আমরা অতিরিক্ত পুলিশ পাঠাই এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। এ ঘটনায় আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে।”

লিটনের অতীত ও রাজনৈতিক পরিচিতি

স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হলেও লিটন সিকদার বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মারামারির অভিযোগে মোট পাঁচটি মামলা রয়েছে। ২০২০ সালে বিএনপির একটি কর্মসূচিতে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোয় দল থেকে বহিষ্কার হন তিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি নিয়মিত বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছিলেন।

মামলা ও তদন্ত

লিটনের বোন মুন্নি সিকদার বাদী হয়ে ৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে এবং দ্রুত জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

জনমনে উদ্বেগ

এই ঘটনায় বরিশালে চরম উদ্বেগ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। একটি পারিবারিক বিরোধ কীভাবে প্রকাশ্যে রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডে রূপ নিতে পারে—তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক সহিংসতার ছায়া নিয়ে আলোচনা চলছে সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *