এইচ এম হাকিম:
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকতার সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত কি বর্তমান সময়ে আছে? নাকি রাজনীতিতে নিজের নীতি-নৈতিকতার কুলমান খেয়ে এক পক্ষের সাফাই গাইতে মরিয়া আমরা!
মফস্বল, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক—যে মাপেরই আপনি সাংবাদিক হন, যদি আপনার ভিতরে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সৎ সাহস না থাকে, তাহলে আমি মনে করি সাংবাদিক হিসেবে আপনি জাতির কাছে বোঝা স্বরূপ।
সাংবাদিকতা হল জনগণের সান্নিধ্যে যাওয়ার একটি মাধ্যম; জনগণের সাথে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের যোগাযোগের সেতুবন্ধনের একটি প্ল্যাটফর্মকেই বলে সাংবাদিকতা। কালের আবর্তে ও ডিজিটালের ছোঁয়ায় সাংবাদিকতার সেই আভিজাত্য, ক্ষেতি এখন মলিন প্রায়।
রাজনৈতিক নেতাদের স্বাধীনতায় গিয়ে নেতাদের চামচামি ও দালালির মাধ্যমে সাংবাদিকতার মুখোশ পরে অপ-সাংবাদিকগুলো জনগণের কাছ থেকে প্রকৃত সাংবাদিকদের বিতাড়িত করার মিশন নিয়েই যেন মাঠে নেমেছে।
তারা চায় জনগণের কাছে সাংবাদিক পেশাটাকে বিতর্কিত করতে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীতে ভুয়া সাংবাদিক আছে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না এবং কখনো কল্পনাও করি না। সাংবাদিক ভুয়া হতে পারে না, ভুয়া হলে সেই হবে যার স্বাক্ষরে কেউ সাংবাদিক পরিচয় দেবার সুযোগ পায়। আমাদের সামনে প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন নিউজের কল্যাণে বিভিন্ন ভুয়া সম্পাদকের কীর্তি দেখি। পত্রিকা প্রকাশনার যে শর্তগুলো থাকে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত হল সম্পাদকের শিক্ষাগত যোগ্যতা। অনেক ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে, অবৈধ কালো টাকার জোরে অশিক্ষিত–মূর্খ, ভূমিদস্যু, বাড়ি জবরদখলকারী, চাঁদাবাজ, মাদক-ইতি ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসীদের লালন-পালনকারী হিসেবে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে, ভুয়া শিক্ষা সনদের মাধ্যমে যে কেউ রাতারাতি সম্পাদক বনে যাচ্ছেন।
একাধিক পত্রিকায় এমন সম্পাদকদের বিরুদ্ধে বারংবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও তারা থেকে যায় অদৃশ্য ক্ষমতার বলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
তাহলে কি রাতারাতি সম্পাদক বনে যাওয়া ব্যক্তিদের হাত অনেক লম্বা? নাকি এদের পেছনে রয়েছে শক্ত কোনো কালো বিড়ালের ছায়া?
এই সকল সম্পাদকদের সাংবাদিক নির্বাচনে থাকে ভিন্নতা। তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে থানার সোর্স, মাদক কারবারি, চাঁদাবাজ-ফাপরবাজ, সবজি বিক্রেতা, হকার, পাম্পের কর্মচারী এবং চায়ের দোকানি। সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে নাম না জানা শত সাংবাদিক সংগঠন। বেশির ভাগ সংগঠন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকলেও কিছু কিছু সাংবাদিক সংগঠনকে ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে—তারা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন। এটা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ।
আবার বিভিন্ন সংগঠনে দেখা যায় অপ-সাংবাদিকদের মিলনমেলা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথাকথিত এক সাংবাদিক সংগঠনের নেতা বলেন, অপ-সাংবাদিকগুলো সংগঠনের অনেক কাজে লাগে। তাদের যেহেতু কোনো কাজ থাকে না, তাই ডাকলেই পাওয়া যায়। মানববন্ধন ও মতবিনিময় সভায় তাদের উপস্থিতি নাকি দ্যুতি ছড়ায়। কিছু কিছু সাংবাদিক সংগঠনে তো অপ-সাংবাদিকরাই নেতৃত্বে আছে। আবার তারাই সারা দেশের উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় লেভেল পর্যন্ত তাদের দৌরাত্ম্য বজায় রেখেছেন।
বাংলাদেশে একটি বিষয় দেখা যায়—আপনি ভালো লিখছেন, দেশের অপরাধ জগত এবং অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করছেন—ভাই, আপনি বিশ্বাস করুন, আপনাকে এ সমাজ বেশি দিন টিকতে দেবে না। আপনাকে হয়তো প্রকাশ্যে হত্যা করা হবে, নয়তো আপনার সহকর্মীদের সাথে আঁতাত করে আপনার রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য ছক কষবে। এ দেশে যারা সত্য লেখার কারণে ভালো মানের সাংবাদিক হয়ে উঠেছে, তাদের ভিতর বেশির ভাগ মানুষের প্রাণ ঝরেছে। (বাংলাদেশে এমন শত শত উদাহরণ রয়েছে।)
১৯৭১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, আমি কি জানতে পারি—সেসব সাংবাদিক পরিবারেরা সঠিক বিচার পেয়েছে?
আছে কি কারো কাছে এই জবাব? সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে গেলেই দেখা যায়, কোনো এক অদৃশ্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির ইন্ধনে সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার একেবারে থেমে যায়।
বাংলাদেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলো কি এতটাই অসহায়?
বেশির ভাগ সময় দেখা যায়—সাংবাদিকদের বিপদে সাহায্যের বদলে সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায় আরেকজন সাংবাদিক!
এই কারণটা কি?
কোনো সংগঠন কি আজ পর্যন্ত এর সমাধান বের করতে পেরেছে?
নাকি একনিষ্ঠভাবে সাংবাদিক সংগঠনগুলো বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে?
আমার প্রায় ২৮ বছরের চোখে বাংলাদেশে ২/৪টি সংগঠন ছাড়া আর কোনো সংগঠন সাংবাদিকদের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।
আমার চোখে এখনো পর্যন্ত পড়েনি। আপনারা কেউ জেনে থাকলে আমাকে তাদের সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন।
আমি আমার নিজের কথায় বলি—আমার উপজেলায় আমি নিজেই এমন শত বাধার উদাহরণ। সেদিন কোনো সাংবাদিক নেতাকে পাশে পাইনি। বরং আমি যে সংগঠনে ছিলাম, সেই সংগঠনের ৬০% লোক আমার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তারা হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনিক দপ্তরে ধরনা দিয়ে চামচামি-দালালি করা সুবিধাবাদী ব্যক্তিরা।
এমন উদাহরণ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এমনকি জাতীয় পর্যায়েও পাবেন। কারণ, কোনোভাবে যদি কোনো সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন, তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিক সহকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে চলেছেন।
এই আজাব থেকে মুক্তি মিলবে কবে? কেউ কি বলতে পারেন?
সারা বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কিছু অযোগ্য ব্যক্তি দখল করে ফেলেছে যোগ্যদের চেয়ার। সেখান থেকেই শুরু হয়েছে প্রকৃত সংবাদকর্মীদের পতন।
বাপের জন্মেও যারা নিউজ লিখতে জানে না, তারা ঠিক উপজেলা, জেলা এমনকি জাতীয় প্রোগ্রামগুলোতেও সামনের চেয়ার দখল করে জানান দিচ্ছেন—”আমি হলাম বানরের কাছ থেকে ঘণ্টা পাওয়া সাংবাদিক!”
বর্তমানে আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছেন কিনা আমার জানা নেই—এত অপ-সাংবাদিকতার কারণে প্রকৃত যারা এই পেশাটিকে সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে, সেই মহান ব্যক্তিগুলো যত দিন যাচ্ছে, ততই আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন।
তাই বলি, পেশাদার সাংবাদিকদের গুরুত্ব দিয়ে অপ-সাংবাদিকতার ঘণ্টা বাজানো মানুষগুলোকে বিতাড়িত করতে হলে এখনই প্রকৃত সাংবাদিকদের ঐক্য গড়ার কোনো বিকল্প নেই।