শেখ মামুনুর রশীদ মামুন:
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার “ফজলুল হক চৌধুরী মহিলা কলেজে” ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠে এসেছে। EIIN নং ১০৪২১৫, কলেজ কোড ৭২৯০—২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে কোনো প্রকার এনটিআরসিএ (NTRCA) নিবন্ধন ছাড়াই ২১ জন শিক্ষককে বিভিন্ন বিষয়ের প্রভাষক পদে ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, প্রত্যেক শিক্ষককে ১৫-২০ লাখ টাকা করে ঘুষ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়ভিত্তিক অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়, যেখানে এক বিষয়ে পড়াশোনা করা প্রার্থীকেও ভিন্ন বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে!
নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম:
একেএম মিজানুর রহমান – প্রভাষক, চারু ও কারুকলা।
ছমির উদ্দিন – প্রভাষক, মৃত্তিকা বিজ্ঞান।
রেবেকা সুলতানা – প্রভাষক, নাট্যকলা।
আফজালুর রহমান – প্রভাষক, সামাজিক সম্পর্ক।
মাধবী সরকার – প্রভাষক, সংস্কৃত।
মোঃ শাজাহান – প্রভাষক, প্রকৌশল অঙ্কন।
আব্দুর রাজ্জাক – প্রভাষক, সংগীত।
মোঃ মহসিন মিয়া – ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা।
নিলুফা আক্তার – গার্হস্থ্য অর্থনীতি।
আতিকুর রহমান – সংগীত।
হেলাল উদ্দিন – নাট্যকলা।
আনোয়ার হোসেন – সংস্কৃত।
এছাড়াও আরও অনেকে ভুয়া নিয়োগপত্রে শিক্ষকতা করে চলেছেন বলে জানা গেছে। ভয়াবহ জালিয়াতি ও প্রশাসনিক প্রতারণা।
এই নিয়োগে নেই কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি, নেই জেলা প্রশাসকের (ডিসি) প্রতিনিধির উপস্থিতি, নেই ফলাফল তালিকা কিংবা স্বচ্ছ নিয়োগ বোর্ডের প্রমাণ। এমনকি সংশ্লিষ্ট ইউএনও ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে নিয়োগপত্র তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়, প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হোসাইন চৌধুরী নিজেই এসব অনিয়মের মূল হোতা বলে অভিযোগ উঠেছে। পিতার নামে কলেজ স্থাপন করে, সেটি এমপিওভুক্ত করে এই ভয়াবহ নিয়োগ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
অধ্যক্ষের প্রতিক্রিয়া:
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ হোসাইন চৌধুরী বলেন, “এসব বিষয়ে মোবাইলে নয়, সরাসরি বসে কথা বলি।” যদিও একাধিক অনুরোধেও তিনি মোবাইলে কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।
আইনি পরিপ্রেক্ষিত:
এ ধরনের ভুয়া নিয়োগ এবং ঘুষ বাণিজ্য ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৬৮, ৪৭১ এবং দুর্নীতি দমন আইনের ৫ ধারায় গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে, যার মধ্যে সরকারি সুবিধা আত্মসাৎ, ভুয়া দলিল তৈরি এবং জাল স্বাক্ষর ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলেছেন, “একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘুষের বাজার বানিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা হচ্ছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি অতি দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা।”
জাতীয় স্বার্থে, শিক্ষার মান রক্ষায় এবং NTRCA-ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা রাখতেই এই কলেজের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
এই প্রতিবেদন শিক্ষাক্ষেত্রে দায়হীনতা ও দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। পাঠকের বিবেককে নাড়া দিতে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে জাগাতে আমরা এই অনুসন্ধান তুলে ধরছি।