শ্যামপুর রেজিস্ট্রি অফিস যেন দীর্ঘদিন ধরে একজন ব্যক্তির ‘ব্যক্তিগত দখলে’ পরিণত হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার:

রাজধানীর শ্যামপুর রেজিস্ট্রি অফিস যেন দীর্ঘদিন ধরে একজন ব্যক্তির ‘ব্যক্তিগত দখলে’ পরিণত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অফিসটির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মফিজ উদ্দিন মুন্সী নামের এক ব্যক্তি পুরো অফিসটি পরিবার ও নিজস্ব প্রভাবশালীদের নিয়ে জিম্মি করে রেখেছেন। স্থানীয়দের ভাষায়, এই অফিসে এখন ‘নিয়ম নয়, চলে মফিজের শাসন’।

সূত্র জানায়, মফিজ উদ্দিন মুন্সী এক সময় ঢাকায় ১৪০০ টাকার একটি টিন সেট ঘরে ভাড়ায় থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি রাজধানীর কদমতলী এলাকায় গড়ে তুলেছেন একাধিক আলিশান বাড়ি। ক্ষমতার অপব্যবহার, দলিল জালিয়াতি, সাধারণ জনগণের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের নাম ব্যবহার করে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তিনি হয়ে উঠেছেন আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি।

এক পরিবার, এক অফিস: নিয়ন্ত্রণে ৮–১২ জন স্বজন

অভিযোগ রয়েছে, শ্যামপুর রেজিস্ট্রি অফিসে মফিজ উদ্দিন মুন্সীর আত্মীয়স্বজনসহ তার অনুগত ৮ থেকে ১২ জন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছেন। তার দুই শালীও রয়েছেন একই অফিসে কর্মরত। এই কারণে অফিসে কোনো ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা কার্যত নেই বললেই চলে।

স্থানীয়রা জানান, দলিল সংশোধন, নামজারি কিংবা রেজিস্ট্রির জন্য সাধারণ মানুষের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। অনেক সময় দলিল নিয়ে কেউ সরাসরি অফিসে গেলে, তাকে নিচতলার একটি নির্দিষ্ট কক্ষে নিয়ে গিয়ে ‘বিশেষ ব্যক্তিদের’ সামনে হাজির করা হয়। সেখানে কথিত জাল দলিল দেখিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং শেষে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।

কোটিপতি হওয়ার রহস্য: রাজনীতির ছায়া, প্রতারণার ফাঁদ

অনুসন্ধানে জানা যায়, মফিজ এক সময় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সানজিদা খানমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই ঘনিষ্ঠতার সুবাদে রাতারাতি তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে স্থানীয়দের দাবি অনুযায়ী, তিনি বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার নাম ভাঙিয়ে অফিসে নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছেন।

একজন ভুক্তভোগী জানান, “মফিজ নিজেই বলেন, ‘আমি বিএনপি করি। আমার অনেক টাকা আছে। তোমাদের পত্রিকার দাম কত, বলো!’” এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চান, তার বিরুদ্ধে কিছুই করার ক্ষমতা কারও নেই।

আরও অভিযোগ রয়েছে, দলিল জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মফিজ। অফিসের বিভিন্ন কাগজপত্র ‘চিনি’ করে (তথ্য বিকৃতি করে) নতুনভাবে তৈরি করা দলিলের মাধ্যমে প্রতারণা করেছেন বহু সাধারণ মানুষের সঙ্গে।

অভিযোগ করলেই হুমকি, নির্যাতন

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই অফিসে কেউ মফিজের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তার জন্য নির্যাতন নিশ্চিত। এমনকি অফিস থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটে।”

স্থানীয়দের মতে, মফিজের প্রভাব এতটাই গভীর যে আশেপাশের দোকানদার ও রেজিস্ট্রি অফিসের অন্যান্য কর্মীরাও আতঙ্কে থাকেন। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। তারা বলেন, “মফিজ মানেই আতঙ্ক। তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই বিপদ।”

দুর্নীতি, জালিয়াতি ও নারীকেলেঙ্কারির অভিযোগ

মফিজের বিরুদ্ধে শুধু দুর্নীতি বা প্রতারণাই নয়, রয়েছে একাধিক ‘মেয়েলী কেলেঙ্কারির’ অভিযোগও। এসব অভিযোগ এতটাই গুরুতর যে অনেক ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার চেয়েও সাহস করে সামনে আসতে পারেন না। জানা গেছে, আগামী দিনে তার এসব অপকর্মের ভিডিওচিত্র, অডিও ও সাক্ষ্যপ্রমাণসহ বড় অনুসন্ধান প্রকাশ পাবে।

স্থানীয়দের দাবি: দুদকের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন

স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মফিজ উদ্দিন মুন্সী ও তার দলবল শ্যামপুর রেজিস্ট্রি অফিসকে ‘ব্যক্তিগত ব্যবসার কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক সময় তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ও করা হয়।

তারা জোর দাবি জানিয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেন শিগগিরই শ্যামপুর রেজিস্ট্রি অফিসে তদন্ত চালায় এবং এই ‘অঘোষিত সম্রাটের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস যদি এমনভাবে এক ব্যক্তির হাতে জিম্মি থাকে, তাহলে নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কোথায়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *