পররাষ্ট্রনীতিতে ড. ইউনূসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:

গত বছরের ৫ আগস্ট মহান ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা পতিত হয়। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। আগামীকাল (৮ আগস্ট) এই সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে।

এই এক বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অধ্যাপক ইউনূসের ভূমিকা এবং সরকারের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড কেমন ছিল, তা ব্যাখ্যা করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।

ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বাসসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “গত এক বছরে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে, যেখানে জাতীয় স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। আমরা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বড় বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে সব দেশের সঙ্গে সমানুভূতিপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছি। আমরা কতটা সফল হয়েছি, তা জনগণ ও সিভিল সোসাইটি মূল্যায়ন করবে।”

উপদেষ্টা বলেন, এই ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান সফলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক কৌশলের প্রাণকেন্দ্র।

অধ্যাপক ইউনূসের কূটনৈতিক প্রভাব ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা

তৌহিদ হোসেন বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা এই সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। “তার সম্মান অনেক দরজা খুলে দেয়, এমনকি সাধারণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় অর্জন সম্ভব না এমন ফলাফলও এনে দেয়।”

তিনি একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, “একটি ফোন কলের মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূস সংযুক্ত আরব আমিরাতে আটক বহু বাংলাদেশির সাধারণ ক্ষমা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেছেন, যা তার ব্যক্তিগত অনুরোধেই সম্ভব হয়।”

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, “বিশ্বজুড়ে তার দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ব্যবসায় অবদানের কারণে ইউনূসের নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এটি শুধু রাজনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সরকার, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী নেতা এবং বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ছড়িয়ে আছে।”

এই ধরনের ‘সফট পাওয়ার’ কৌশল বাংলাদেশের কূটনীতিতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক: ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টায় অন্তর্বর্তী সরকার

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, আগের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। “তবে কিছু জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছি।”

তিনি উল্লেখ করেন, বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা ও স্থলবন্দর সংক্রান্ত কিছু অমীমাংসিত বিষয় থাকলেও বাণিজ্য কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে ভারতের দিকে যাওয়া ভ্রমণ এবং চিকিৎসা ও পর্যটনে কিছু হ্রাস লক্ষণীয়।

তৌহিদ বলেন, “ভোক্তা পর্যটন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমে যাওয়াকে বাংলাদেশ ক্ষতি হিসেবে দেখি না। কারণ এটি দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি সাধনে সহায়ক।”

সীমান্তে হত্যা ও অনিয়মিত পুশ-ইন নিয়ে কড়া প্রতিবাদ

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে মানুষ হত্যার ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ আরও জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত এক বছরে ভারতকে কঠোর প্রতিবাদপত্র দেয়া হয়েছে।”

সরকার দাবি করেছে, এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর কখনো যেন না ঘটে, প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

তৌহিদ হোসেন আরও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “সীমান্তে অনিয়মিত পুশ-ইন হচ্ছে, যেখানে শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদেরও জোরপূর্বক ঠেলে পাঠানো হচ্ছে, যা আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করি না। আমরা এই পদ্ধতি বন্ধ করার জন্য ভারতকে স্পষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছি।”

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ

গত এক বছরে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা সুবিধা।

তৌহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের প্রতি কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা শুধুমাত্র স্বাভাবিক ও সমন্বিত সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই যা দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে।”

তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, “গত সরকার আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষিত হয়েছিল, যা অপ্রয়োজনীয় ছিল।”

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দীর্ঘমেয়াদী ও স্থিতিশীল সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “১৯৭৫ সাল থেকে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের চীন সম্পর্ক কখনো খারাপ হয়নি।”

তৌহিদ ‘চীনের খুব কাছাকাছি’ হওয়ার মিথ্যাভাষাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আমাদের সম্পর্ক দুই দেশের স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং একতরফা নয়।”

যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও তিনি বলেন, “আমরা চীনের দিকে ঝুঁকছি না, আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষা করছি এবং একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখছি।”

বিশ্বের ক্রমবর্ধমান দ্বিমেরু ভিত্তিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ বাস্তববাদী ও স্বার্থভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জটিলতা ও আশা

তৌহিদ হোসেন স্বীকার করেন, গত আট বছর ধরে বাংলাদেশ মানবিক কারণে এক মিলিয়নেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। তবে অর্থবহ প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা এখনও দূরবর্তী।

বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমারের কিছু অগ্রগতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরে না এলে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে কারও জোরপূর্বক ফেরত পাঠায় না।”

বৈশ্বিক কূটনৈতিক উপস্থিতি বৃদ্ধি

গত এক বছরে ঢাকা আন্তর্জাতিক মিশনের সংখ্যাও বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। নিউজিল্যান্ডে একটি হাইকমিশন ও মালয়েশিয়ার জহর বাহরুতে একটি কনস্যুলেট খোলার অনুমোদন এসেছে।

তৌহিদ জানান, এছাড়া পেনাং ও গুয়াংজুতে কনস্যুলেট এবং আয়ারল্যান্ডে দূতাবাস খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা প্রবাসীদের সেবা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে সাহায্য করবে।

প্রবাসী কল্যাণে সরকারের অগ্রাধিকার

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভোগ লাঘব করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে নতুন সেবা যেমন ওমানের জন্য ই-পাসপোর্ট সরাসরি বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ইতিবাচক উদাহরণ।”

তিনি আরও জানান, মিশনগুলোকে প্রবাসীদের সুবিধার্থে ছায়াযুক্ত অপেক্ষাকক্ষ তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কার

তৌহিদ বলেন, “গত এক বছরে আমরা কোনো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিইনি। প্রায় ৪০০ জন ক্যাডারের ওপর মন্ত্রণালয় ও মিশনগুলো নির্ভর করছে।”

তিনি আরও বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের কোনো পোস্ট ফাঁকা রাখা হবে না, প্রয়োজনে ইউরোপের কিছু পোস্ট সাময়িক ফাঁকা রাখা যেতে পারে।”

উপসংহার

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন উপসংহারে বলেন, “সরকার এমন কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা সমস্ত দেশের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে, গঠনমূলক, ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত হবে এবং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *