কামরুল ইসলাম:
আগামী ৪ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ—চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ঐতিহাসিক ১৯ দিনব্যাপী চুনতি সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল। এটি হবে মাহফিলের ৪৮তম আয়োজন।
১৯৭২ সালে চুনতির আধ্যাত্মিক নেতা ও অলিকুল শিরোমণি হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.) শাহ সাহেব কেবলার উদ্যোগে শুরু হওয়া এই মাহফিল বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম ধারাবাহিক সীরাত মাহফিল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
চুনতির ইতিহাস ও মাহফিলের শুরুর কাহিনি
পাহাড়বেষ্টিত নয়নাভিরাম চুনতি গ্রাম চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দক্ষিণে, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এখানেই রয়েছে শাহ সাহেব কেবলার মাজার, মসজিদে বায়তুল্লাহ এবং ১৩ একর আয়তনের বিশাল সীরাত ময়দান।
১৯৭২ সালে প্রথমবার মাত্র এক দিনের আয়োজন দিয়ে সূচনা হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে এর পরিসর বাড়তে থাকে—১৯৭৩ সালে ২ দিন, ১৯৭৪ সালে ৩ দিন, ১৯৭৫ সালে ৫ দিন, ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে ১২ দিন, ১৯৭৯ সালে ১৭ দিন এবং ১৯৮০ সাল থেকে স্থায়ীভাবে ১৯ দিনব্যাপী মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
হযরত শাহ সাহেব কেবলার জীবন ও আধ্যাত্মিক ভূমিকা
১৯০৭ সালে চুনতিতে জন্ম নেওয়া শাহ সাহেব কেবলা আধ্যাত্মিক জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। শৈশবে পিতৃহারা হয়ে তিনি পিতামহ আলহাজ্ব মুফতি মাওলানা কাজী ইউছুফ (রহ.) এর তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করেন। পরে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া ও কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাযিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
জীবনের একটি দীর্ঘ সময় তিনি মিয়ানমারের বাম্বু শহরে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পাহাড়–জঙ্গল, শহর–বন্দর ঘুরে আল্লাহর জিকির ও রাসূল (সা.)-এর প্রশংসা প্রচার করেন। তাঁর অসংখ্য কারামতের মধ্যে অন্যতম ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরকান সড়কে আটকে পড়া গাড়িবহরকে অলৌকিকভাবে উদ্ধার করা, যা তাঁকে ‘চুনতির হাজেম মামু’ হিসেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামে পরিচিতি এনে দেয়।
মাহফিলের বিশাল আয়োজন
প্রতি বছর ১৯ দিনব্যাপী এই মাহফিলে দেশ–বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলিম অংশগ্রহণ করেন। এখানে আগত সবাইকে বিনামূল্যে আহারের ব্যবস্থা করা হয়—যা এখনো পর্যন্ত কোনো বছর ঘাটতিতে পড়েনি। সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত এই আয়োজনকে অনেকেই বিশ্বের বৃহত্তম গ্রামীণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে মনে করেন।
মাহফিল চলাকালে ওয়ায়েজগণ ইসলামের শিক্ষা, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শ, সমাজের সঠিক পথনির্দেশ ও নৈতিকতা নিয়ে বয়ান করেন। শাহ সাহেব কেবলা জীবিত থাকাকালে মাহফিলের প্রতিটি কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে তা নির্দেশ করতেন।
শাহ সাহেব কেবলার ইন্তেকাল ও উত্তরাধিকার
২৩ সফর ১৪০৪ হিজরি (২৯ নভেম্বর ১৯৮৩) সোমবার তিনি ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে তাঁর মাজার মসজিদে বায়তুল্লাহর দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত। মৃত্যুর পরও তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব এবং মাহফিলের ঐতিহ্য অটুট রয়েছে।
চুনতি সীরাত মাহফিল শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি এক ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মিলনমেলা, যা ইসলামের বাণী প্রচার এবং ঐক্য-ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে অনন্য ভূমিকা রাখছে।