সাইমুন ইসলাম সাইফুল্লাহ:
বর্ষার ভরা মৌসুম। আকাশে মেঘ, মাঠে পানি, চারপাশে সবুজের ছোঁয়া। এ সময়টাতেই যেন প্রাণ ফিরে পায় উপকূলের কৃষকরা। যেদিকে চোখ যায়, শুধু কাদা মাখা জমি আর কৃষকের কর্মচাঞ্চল্য। আমন ধান রোপণের এ মৌসুমে উপকূলের মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনছেন ফসলের মাঠে।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নানা বয়সী কৃষকরা মাঠে নেমে পড়েন। কাদা-পানির ভেতর একে একে সাজানো হচ্ছে সবুজ চারা। কাদায় পা ডুবে যাচ্ছে, শরীর জড়িয়ে যাচ্ছে কাদা। তবুও চোখ-মুখে নেই ক্লান্তি। বরং সবার চোখ-মুখে ফুটে উঠছে আনন্দ আর আশা। যেন কাদা নয়, জমির বুকে বুনছে তারা আগামীর স্বপ্ন।
কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, “ধান রোপণ মানে শুধু ফসল নয়, পরিবারের ভবিষ্যৎ। যদি ফসল ভালো হয় তবে সারা বছর চাল কিনতে হয় না। বছর শেষে লাভ হয়।”
সরেজমিনে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠে কৃষকরা আমন ধান রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কোথাও ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ হচ্ছে, কোথাও চলছে আগাছা পরিষ্কার, আবার কোথাও দলবদ্ধভাবে চারা রোপণ চলছে। দেশি ধানের পরিবর্তে এখন কৃষকেরা বেশি চাষ করছেন ব্রি ধান-৪৯, ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২ এবং দেশি সাদা মোটা, জিরা বাদামসহ হাইব্রিড জাত। বৃষ্টির পানিতে জমি তৈরির পর কৃষকরা চারা রোপণ করছেন। পানি সেচ ছাড়াই রোপণকৃত চারাও ভালো হচ্ছে। বিগত বছরের তুলনায় এবছর কৃষকরা আমন চাষে বেশি ঝুঁকছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে সময় মতো ধান রোপণ সম্ভব হচ্ছে।
লতাচাপলী ইউনিয়নের আছালতপাড়া গ্রামের কৃষক কামাল হোসেন বলেন, “এ বছর বর্ষার শুরুতে বৃষ্টি ছিল। তাই বীজতলা তৈরি ও হালচাষে বিলম্ব হয়নি। তবে গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি না থাকায় কোথাও কোথাও চাষের জমি শুকিয়ে গেছে।”
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় ৩০,৮৩০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হবে। এরই মধ্যে কৃষকরা জমি তৈরি, বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন ও রোপণের কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যে ১৮,৫০০ হেক্টরে ইতোমধ্যেই চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই শতভাগ রোপণ সম্পন্ন হবে। ভালো আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়মুক্ত মৌসুম থাকলে উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে কৃষকের পথ সহজ নয়। জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি কিংবা লবণাক্ত পানির প্রবাহ ফসলের সবচেয়ে বড় শত্রু। বহুবার দেখা গেছে, ভালোভাবে রোপণ শেষে কয়েক ঘণ্টার ঘূর্ণিঝড়ে কৃষকের সব আশা তলিয়ে যায়। তবু তারা হাল ছাড়েন না। আবার চারা তুলে, নতুন করে রোপণ শুরু করেন।
কৃষক খোকন কাজী হাসিমুখে বললেন, “কাদা-মাটি, ভেজা শরীর, ব্যথা সব ভুলে যাই যখন দেখি সবুজ চারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।”
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ নাহিদ হাসান বলেন, “বর্ষা মৌসুমে উপজেলার উঁচু জমিগুলো অলস পড়ে থাকে। তাই কৃষকদের আমন ধান রোপণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর উপজেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিদিন কৃষকের কাছে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আমন রোপণ হবে।”
ধানের চারা যেমন কাদামাটি থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তেমনি উপকূলের কৃষকরাও প্রতিকূলতার মাঝেই খুঁজে নেন জীবনের স্বপ্ন। আমন ধান রোপণের এ মৌসুম শুধু কৃষিকাজ নয়, বরং উপকূলের সংগ্রামী মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক।