ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য, লাইসেন্স পেতে ঘুষ

স্টাফ রিপোর্টার: 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের শরিফ উদ্দিন পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন ৩৫ কিলোমিটার দূরে মোটরসাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যান। ফি জমা দিয়ে আবেদন করার পরও আজও তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাননি। এরই মধ্যে অসংখ্যবার জরিমানাও দিতে হয়েছে তাকে।

তবে শরিফ উদ্দিন একা নন—এমন অভিযোগে ভুক্তভোগীদের সংখ্যা হাজারেরও বেশি।

ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা : “কারও লোক না হলে কাজ হয় না”

নবীনগরের তৌফিক আহমেদ বলেন,
“২০২০ সালে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমি কার লোক। ‘না’ বলায় আমাকে বের করে দেওয়া হয়। পরে অফিসের এক স্টাফ আবু বক্করের মাধ্যমে ৯ হাজার টাকা দিলেও আজ পর্যন্ত লাইসেন্স পাইনি।”

সিএনজি অটোরিকশাচালক রোমান মিয়া জানান, তিনি ২০১৮ সালে এক দালালকে ১২ হাজার টাকা দিলেও লাইসেন্স পাননি। পরে আরেক দালালকে ১৮ হাজার টাকা দিয়েও ব্যর্থ হন।

বিআরটিএ অফিস : দালালদের রাজত্ব

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সার্কেল বিআরটিএ অফিস দালালদের নিয়ন্ত্রণে। চয়ন, আজাদ, শাহ আলম, মোস্তাকিম, আবুল, মেড্ডার খোকন, শরীফ, কসবার শাহ আলম, সামীর ও আহসান— এদের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায়।

অফিসের ফটকেই তারা বসে থাকেন এবং স্টাফদের সঙ্গে প্রকাশ্যে ওঠাবসা করেন। এমনকি সরকারি কর্মসূচিতেও কর্মকর্তাদের পাশে দেখা যায় তাদের।

অন্যদিকে মফিজ ও আবু বক্কর নামে দুজন সরাসরি অফিস স্টাফ পরিচয় দিয়ে কাজ করছেন, অথচ তাদের কোনো নিয়োগপত্র নেই।

দালাল মোস্তাকিম, আবুল ও খোকন

অভিযোগের তীর মোটরযান পরিদর্শকের দিকে

ভুক্তভোগীদের দাবি, এ দালাল সিন্ডিকেটকে “ম্যানেজ” করছেন মোটরযান পরিদর্শক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ
তাদের অভিযোগ, ফাইলের ধাপগুলোতে অযথা জটিলতা তৈরি করা হয়, পরে দালালদের মাধ্যমে টাকা দিলে মুহূর্তেই কাজ এগিয়ে যায়। স্থানীয়দের মতে, প্রতিটি ফাইল থেকে নিয়মিত টাকা হাতবদল হয় এবং এই চক্রের পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ছত্রছায়া রয়েছে।

সচেতন নাগরিকদের প্রশ্ন—একজন মোটরযান পরিদর্শকের প্রত্যক্ষ তদারকির দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও কীভাবে দালালদের এমন প্রকাশ্য দৌরাত্ম্য চলতে পারে?

দালাল ছাড়া লাইসেন্স অসম্ভব

বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী লার্নার লাইসেন্স, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা, ভাইভা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ডোপ টেস্ট— সবকিছু ধাপে ধাপে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ভুক্তভোগীরা বলেন, দালাল ছাড়া এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা অসম্ভব।

লাইসেন্সপ্রতি দালালরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নেন। পরীক্ষা থেকে শুরু করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ডোপ টেস্ট—সব কিছু তারাই ম্যানেজ করে দেন।

সিএনজি অটোরিকশার লাইসেন্সহীন দৌরাত্ম্য

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১৫-১৮ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলছে। কিন্তু লাইসেন্স আছে মাত্র ৫ হাজার ২৫০টির। বাকি সবগুলো চলছে লাইসেন্স ছাড়াই।

প্রশাসনের বক্তব্য

বিআরটিএ অফিসের সহকারী পরিচালক আশরাফ উদ্দিন সিদ্দিক বলেন,
“আমি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছি। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে দালালদের ধরিয়ে পুলিশে দেওয়া হবে।”

নিজেকে ‘সিল মেকানিক’ পরিচয় দেওয়া আবু বক্করকে নিয়োগবিহীন স্বীকার করে তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে এভাবে কাজ করছেন।

জনভোগান্তি ও দুর্নীতির সংস্কৃতি

সাধারণ মানুষের অভিযোগ—যারা দালালকে টাকা দেন, তারাই কাঙ্ক্ষিত সেবা পান। আর যারা নিয়ম মেনে আবেদন করেন, তারা বছরের পর বছর ঘুরতে থাকেন। এতে একদিকে রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতির সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *