স্টাফ রিপোর্টার:
ছাত্র-জনতার রক্তের স্রোতে এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর পর যখন দেশ মহা সংস্কারের পথে হাঁটছে, ঠিক তখনও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বহন করছে স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের। প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা বেগম মলি স্বৈরাচার আমলের অন্যতম সহযোগী এবং রাজউক শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত। জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের আসামি হিসেবেও তার নাম রয়েছে।
তবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি রাজউক কর্তৃপক্ষ। এতে দপ্তরে সমালোচনার ঝড় বইছে। জানা গেছে, স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে রাজউকের বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। সূত্র জানায়, জুলাই গণহত্যা মামলায় এসব কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে অর্থ সরবরাহ করতেন। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগও জমা রয়েছে, যা এখন তদন্তাধীন।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর ছাত্র-জনতার আন্দোলন ভণ্ডুল করার সহযোগী হিসেবে পরিচিত এসব কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। একইসঙ্গে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও জুলাইয়ের নৃশংস ঘটনার সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
আদালতের মামলা ও ফাতেমা বেগম মলি
তদন্তে জানা যায়, রাজউকের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা বেগম মলির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তিনি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে অর্থ সহায়তা দেন এবং ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ও দাঙ্গা উসকে দিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন।
এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জনস্বার্থে দায়ের করা হয় সিআর মামলা নং ৯৯/২০২৫। মামলাটি ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দায়ের হয় এবং আদালতের আদেশে শাহআলী থানায় ফৌজদারি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। মামলায় মোট ১৭৪ জনকে আসামি করা হয়। এ তালিকায় ফাতেমা বেগম মলির নাম রয়েছে ১৫৬ নম্বরে, আর তার স্বামী আবুল ফজল রাজু রয়েছেন ১৬০ নম্বরে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই
হত্যা মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও রাজউকের পক্ষ থেকে ফাতেমা বেগম মলির বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তিনি এখনো তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (প্রকল্প) কার্যালয়ে বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। অভিযোগ রয়েছে, মামলা থেকে নিজের ও স্বামীর নাম বাদ দেওয়ার জন্য বাদীর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন তিনি।
রাজউকের আইন শাখার এক কর্মকর্তা জানান, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় তদন্ত শুরু করা বাধ্যতামূলক। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও উচ্চ আদালতের একাধিক রায়ে এ বিষয়টি স্পষ্ট। এমনকি জামিন পেলেও তাদের চাকরি স্থগিত রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু ফাতেমা বেগম মলির ক্ষেত্রে এসব আইন উপেক্ষা করা হচ্ছে।
দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ
ফাতেমা বেগম মলির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের একাধিক অভিযোগও রয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাসের নেতৃত্বে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি বড় অংকের ঘুষের বিনিময়ে অনুসন্ধান স্থগিত রাখার ব্যবস্থা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া, রাজউকের শ্রমিক লীগে প্রভাব বিস্তার করে তিনি এবং তার স্বামী বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট, পূর্বাচলে প্লট, দামি গাড়ি এবং নারায়ণগঞ্জে বিপুল জমি তাদের দখলে আছে। এসব সম্পদের বাজারমূল্য অন্তত ৫০ কোটি টাকা বলে জানা যায়।
তার স্বামী আবুল ফজল রাজু আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক পল্লী উন্নয়ন সম্পাদক এবং ‘রাজু ইন্টারন্যাশনাল’ ও ‘রাজু প্রপার্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপারস’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অভিযোগ রয়েছে, ফাতেমার সহযোগিতায় রাজউকের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ
হত্যা মামলা ও দুর্নীতির বিষয়ে ফাতেমা বেগম মলির বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
আরও তথ্য প্রকাশের প্রস্তুতি
বিশেষ অনুসন্ধানে ফাতেমা বেগম মলির বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার দপ্তরিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের নথিপত্র আগামী সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।