আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিরপুরে বহুতল ভবন নির্মাণে নর্দার্ন প্রোপার্টিজ

স্টাফ রিপোর্টার:

মহামান্য আদালতের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মিরপুরে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে একটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ। ইতোমধ্যে ২টি বেইজমেন্টসহ ১০ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। বহুমুখী ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সমবায় সমিতির মালিকানাধীন জমিতে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান নর্দার্ন প্রোপার্টিজ ভবনটি নির্মাণ করছে।

মিরপুর-১০, মেইন রোড, বি-ব্লকের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ে সমবায় সমিতির জায়গায় ভবনটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। তখন নর্দার্ন প্রোপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক স্মারক নং-২৫.৩৯.০০০০.০৯৮.৩৩.১৩৬.১৮) অনুমোদন দেয় ১৫ তলা বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের নকশা।

তথ্যমতে, ১০ তলার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক ছাড়পত্র ও নকশা ছাড়াও একাধিক শর্ত যেমন— ভবনের উচ্চতা, ফ্লোর স্পেস ইনডেক্স (FSI), অগ্নি সুরক্ষা, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (FAR) ও স্থাপত্যজনিত বিভিন্ন নিয়ম কঠোরভাবে মানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু নর্দার্ন প্রোপার্টিজ শুরু থেকেই এসব শর্তের তোয়াক্কা করেনি। পাইলিং থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে রাজউক অনুমোদিত নকশা ভঙ্গ করে এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই নির্মাণকাজ এগিয়ে নিচ্ছে তারা।

প্রায় একবিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এই ভবনে চারপাশে নির্ধারিত পরিমাণ ফাঁকা জায়গা রাখা হয়নি। নকশা অনুযায়ী ভবনের পেছনে ৪০%, দুই পাশে ১৫% এবং সামনের দিকে কমপক্ষে ১০% জায়গা ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও ডেভেলপার কর্তৃপক্ষ বড় ধরনের ডেভিয়েশন করেছে। একইসঙ্গে পর্যাপ্ত ভয়েড নেই, সিঁড়ি ও লিফট স্থাপনেও অসঙ্গতি রয়েছে। বলা যায়— মোট জমির প্রায় ৯৫% জুড়েই নির্মাণ হচ্ছে সমবায় সমিতির ভবনটি।

এসব অনিয়মের কারণে প্রথমে মৌখিক সতর্কতা ও পরে একাধিক কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় রাজউক। এর ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে রাজউকের এক নোটিশের (স্মারক নং-২৫.৩৯.০০০০.০৯৮.৩২.১১৪.২০২২/১৪৩৩) পর নর্দার্ন চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ উচ্চ আদালতে রিট (নং-১৪৬৯৪/২০২৩) দায়ের করেন, যা ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত বৈধ ছিল। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার আপিলে মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়।

কিন্তু আদালতের শর্ত অনুযায়ী রিট চলাকালে ভবনের সব কাজ বন্ধ থাকার কথা থাকলেও নর্দার্ন প্রোপার্টিজ তা মানেনি। নির্মাণ শুরুর সময় যেখানে ২ বেইজমেন্টসহ ৪ তলার কাজ হয়েছিল, সেখানে এখন ১০ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন।

রাজউক সূত্র জানায়— অনুমোদন থেকে শুরু করে সর্বশেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নিয়মভঙ্গ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আদালতের নির্দেশও উপেক্ষা করে ভবন নির্মাণ চলছে। এ সময়ের মধ্যে রাজউকের একাধিক অথরাইজড অফিসার ও বিল্ডিং ইন্সপেক্টর দায়িত্বে থেকেও কার্যত অসহায়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবেশীদের আপত্তি বা তদন্তে গেলে রাজউকের কর্মকর্তাদের ভেতরে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬ বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে নকশা ছাড়া কিংবা জালিয়াতির মাধ্যমে ডজন ডজন বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে নর্দার্ন প্রোপার্টিজ ও প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেড। শুধু ঢাকাতেই নয়, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, কক্সবাজারসহ নানা জায়গায় তারা ২০০টির বেশি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তুলেছে। এর মধ্যে রাজধানীর নয়া পল্টনের ৩/১১, কালভার্ট রোডে অনুমোদনবিহীন ১৭ তলা ভবনও রয়েছে। রাজউকের কয়েকশ মিটার দূরে অবস্থিত এই ভবনটিও জালিয়াতির মাধ্যমে নির্মিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন ইমারত পরিদর্শক দৈনিক সময়কে বলেন— “আমরা ছোট চাকরি করি। নর্দার্নের চেয়ারম্যান মানেই বিশাল ক্ষমতাধর একজন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেখানে ভয় পান, সেখানে আমরা তো কিছুই করতে পারি না। তাদের প্রকল্পে ঢুকতে গেলেই লোকজন বাধা দেয়, বেইজমেন্টে তো যাওয়া দূরের কথা।”

রাজউকের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন— “আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ শেখ হাসিনা পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিগত সরকার আমলে তাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করত না। শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সেই প্রভাব খাটিয়ে তিনি গত দেড় যুগে মানি লন্ডারিং, অবৈধ সম্পদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন।”

অভিযোগ রয়েছে, সমবায় সমিতির এই ভবনে প্রায় ৫০০ দোকান বিক্রি হয়েছে— প্রতিটির দাম ৮০ লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত। পুরনো কমিটি দোকান বিক্রি করলেও নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক দোকান পুনরায় অন্যের কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।

প্রশ্ন হলো— আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও মিরপুরের মতো এলাকায় কীভাবে প্রকাশ্যে ১০ তলা পর্যন্ত নির্মাণ এগোলো? রাজউকের অথরাইজড অফিসার বলেন— “যতদূর জানি, আদালতে রিট চলমান আছে। রায়ের আগে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। তবু বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে এবং অনিয়ম প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এ বিষয়ে রাজউকের পরিচালক (জোন-৩) সালেহ আহমদ জাকারিয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায়ও কোনো সাড়া মেলেনি।

উল্লেখ্য, প্রতারণার মামলায় ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি নর্দার্ন প্রোপার্টিজ, প্রাসাদ নির্মাণ ও নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের দায়ের করা মামলায় (খিলক্ষেত থানার মামলা নং-১৪) পিবিআই তাকে বনানী অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে। মামলায় উল্লেখ ছিল— ২০১৩ সালে জমি কেনার নামে ৩০ কোটি টাকা নেওয়ার পরও বাকি অর্থ না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন তিনি।

এছাড়া নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, বিদেশে পাচার এবং অপ্রদর্শিত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চলতি বছরের ২০ মে আদালত তার ও পরিবারের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন।

অভিযোগ আরও আছে— সাংবাদিকদের রিপোর্ট বন্ধে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন কর্মকর্তা, প্রতিনিধি এবং পিআরডি শাখার কর্মীরা বারবার যোগাযোগ করে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন। এমনকি বিজ্ঞাপন ছাপানোর বিনিময়ে প্রতিবেদন না করার অনুরোধও এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *