দুই দশকেও কাটেনি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট

মোছাঃ মাহমুদা আক্তার নাঈমা

জাককানইবি প্রতিনিধি:

সেই ২০০৬ সালে শুরু হয় যাত্রা।অথচ প্রতিষ্ঠার দুই দশকেও শিক্ষক সংকট কাটেনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিবছর নতুন নতুন বিভাগ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা না বাড়ায়, প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় অর্ধেকেরও কম শিক্ষক কর্মরত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে – পাঠদান, গবেষণা ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে দেখা দিয়েছে অসম্পুর্ণ সিলেবাস, সেশনজটসহ নানা সমস্যা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রকাশনা অনুযায়ী, বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১০ হাজার ৮০৯ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। উচ্চশিক্ষার মানদণ্ড অনুসারে প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন পূর্ণকালীন শিক্ষক প্রয়োজন। সে হিসেবে এখানে থাকা উচিত অন্তত ৫৪০ জন শিক্ষক। কিন্তু বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ২২০ জন। এর মধ্যে আবার অনেকে শিক্ষাছুটিতে থাকায় কার্যত সক্রিয় শিক্ষক সংখ্যা আরও কম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা গেছে, ২৬টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের মধ্যে নয়টি বিভাগে শিক্ষক সংখ্যা পাঁচজন বা তারও কম। এর মধ্যে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজে কোনো শিক্ষকই নেই। পপুলেশন সায়েন্স বিভাগে ৮ জন অনুমোদিত শিক্ষক থাকলেও ৪ জন শিক্ষাছুটিতে থাকায় ব্যহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়া দর্শন, মার্কেটিং ও নৃবিজ্ঞান বিভাগেও মাত্র ৪ জন শিক্ষক কর্মরত। ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ৫ জন, পরিসংখ্যান বিভাগ ও ইতিহাস বিভাগে ৩ জন করে শিক্ষক কর্মরত আছে। ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে কার্যত দুজন শিক্ষক দিয়ে পুরো বিভাগের পাঠদান চালানো হচ্ছে।

অথচ ইউজিসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী আউটকাম বেইজড এডুকেশন (ওবিই) পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি বিভাগে অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন শিক্ষক প্রয়োজন।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “বেশকিছু বিভাগে শিক্ষক সংকটের বিষয়ে অবগত আছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা বারবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) অবহিত করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিও দেওয়া হয়েছে একাধিকবার। ইউজিসি বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিলেও এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া নতুন শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব নয়।”

এদিকে শিক্ষার্থীরা বলছেন, মাত্র তিন-চারজন শিক্ষক দিয়ে একাধিক কোর্স পড়ানো সম্ভব না হওয়ায় বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা এসে ক্লাস করাচ্ছেন। এতে প্রায় কোর্সের সিলেবাস অসম্পুর্ণ থেকে যায়, পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্বিত হয়। কোর্স শেষ না করেও পরীক্ষা দিতে হয় অনেকসময়।

মার্কেটিং বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাতুল রহমান বলেন, শিক্ষক সংকট একজন শিক্ষককে ক্লাসে অতিরিক্ত সময় ব্যয়ে বাধ্য করে। এতে পাঠদানের মান যেমন হ্রাস পায়, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়।’

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইউসুফ বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে না। এতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছি। বিভাগে অভিযোগ জানালে শিক্ষক সংকটের কথা বলা হয়।”

এদিকে শিক্ষক সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুল মোমেন বলেন, ‘প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন পূর্ণকালীন শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্যে মাত্র দুই থেকে চারজন শিক্ষক কর্মরত আছেন। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাতকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। আমাদের মার্কেটিং বিভাগের মাত্র চারজন শিক্ষক নিয়ে ৫টি ব্যাচের ২৫টি কোর্সের ক্লাস নিয়মিত নেয়া অনেক কষ্টসাধ্য। অতিরিক্ত কোনো ইভেন্ট, সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজন করা যায় না, গবেষণার প্রতিও মনোযোগ ব্যহত হয়।’

ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ শামসুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞান বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু সংকটের ফলে একজন শিক্ষককে একইসাথে ক্লাস, খাতা মূল্যায়ন, গবেষণা, প্রশ্ন তৈরিসহ প্রশাসনিক নানা দায়িত্ব পালন করতে হয়। পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকলে পাঠদান ব্যাহত হয়, কোয়ালিটি এডুকেশন বিঘ্নিত হয়। একইসাথে ইউজিসি নির্দেশিত ওবিই বাস্তবায়নও কঠিন হয়ে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীরা কোয়ালিটি এডুকেশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা সময়মতো কোর্স শেষ করতে পারছেন না। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় অনেকেই মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে শুধু সেশনজটই নয়, গবেষণা কার্যক্রম ও নতুন শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *