ডেমরার রূপসী পল্লী টাওয়ার হাউজিংয়ের মালিক রমজান আলী মাস্টার একাধিক সাংবাদিকদের পালে

স্টাফ রিপোর্টার:

সামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজের মাস্টার রমজান আলী শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর এই মাস্টার রমজান আলী শিক্ষকতার আড়ালে করতেন অবৈধ ব্যবসা। যে ব্যবসার টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে রাতারাতি হয়েছেন কোটিপতি। গড়ে তুলেছেন রূপসী পল্লী হাউজিং কোম্পানি। স্কুলের ছেলে-মেয়েদের পিতা-মাতাদের জিম্মি করে কিনতে বাধ্য করতেন তার নিজের হাউজিংয়ের শেয়ার। একসময় ওই শেয়ারগুলো আত্মসাৎ করতেন নিজেই।

এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মাস্টার রমজান আলী বলেন, “আমি ডেমরা, যাত্রাবাড়ীর প্রায় ৫০ জন সাংবাদিককে লালন-পালন করি। তারা সবাই আমার কাছে আসে, আর আমি তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে খুশি রাখি। বিগত দিনে আওয়ামী লীগ নেতাদের লালন-পালন করলেও বর্তমানে আবার বিএনপির নেতাকর্মীদের লালন-পালন করছি। যার টাকা আছে, তার সবই আছে। আমি বড় বড় নেতাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। আমার আর কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর লোকজনও আমার কাছে আসে, তাদেরও আমি টাকা দিয়ে খুশি রাখি।”

মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস প্রেস সোসাইটি দুদকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জনস্বার্থে লিখিত অভিযোগ করেছে বলে জানা গেছে।

রাজধানীর ডেমরা থানাধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে বহুল আলোচিত রূপসী পল্লী টাওয়ার হাউজিংয়ের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব মনিরুজ্জামান ওরফে মনির মাস্টারকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত ১৩ আগস্ট (মঙ্গলবার) গভীর রাতে ডেমরার মুসলিম নগর এলাকায় নিজ বাসা থেকে ডিবির বিশেষ দল অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে।

মনির মাস্টার ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের পলাতক সভাপতি এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খান মাসুদের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং সামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজ শাখা আওয়ামী লীগের ৩ নম্বর ইউনিটের সভাপতি ছিলেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডেমরা এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জমি দখল এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে রেখেছিলেন।

গ্রেফতারের আতঙ্কে পালিয়ে যান রমজান আলী মাস্টার:
মনির মাস্টারের গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এতে আতঙ্কে পড়ে যান তার অন্যতম সহযোগী, রূপসী পল্লী টাওয়ার হাউজিংয়ের মালিক আলহাজ্ব রমজান আলী মাস্টার। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একসময় হতদরিদ্র অবস্থায় সামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করা রমজান আলী বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক। তিনি ১৪ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) ভোরে নিজ বাসা থেকে গোপনে অন্যত্র পালিয়ে যান।

রমজান আলী মাস্টার অতীতে ডিএসসিসি ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি ডেমরার কুখ্যাত ভূমিদস্যু ও গ্রেফতারকৃত কাউন্সিলর আলহাজ্ব শামসুদ্দিন ভূঁইয়া সেন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেও পরিচিত। সেন্টুর ছত্রছায়ায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি খাস জমি দখল ও বহুতল ভবন নির্মাণ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।

ছাত্র আন্দোলন দমন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মনির মাস্টারের নেতৃত্বে ডেমরা এভিনিউ ওয়ান চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে যুবলীগ—ছাত্রলীগ কর্মীদের সশস্ত্র অবস্থান নিতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তারা মাতুয়াইল মেডিকেল রোড, বাদশা মিয়া রোড ও সাইনবোর্ড এলাকায় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় এবং সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও পথচারীদের ওপর হামলা চালায়। অভিযোগ রয়েছে, এই আন্দোলন দমন করতে অর্থের যোগানদাতা ছিলেন রমজান আলী মাস্টার। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে পুরো পরিকল্পনা পরিচালনা করতেন। জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র হত্যার অন্তত ১২টি মামলার আসামি তিনি।

রূপসী পল্লী টাওয়ার নির্মাণে দুর্নীতি:
রমজান আলী মাস্টার রূপসী পল্লী টাওয়ার হাউজিংয়ের নামে ১ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি রাজউক ও ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব অবৈধ বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। এছাড়া ভবনগুলোর বেজমেন্ট ঢালাইয়ের সময় মানসম্পন্ন পাথরের বদলে ইটের কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। ফলে পুরো ভবনগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং শত শত পরিবার মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

নিজেকে অদম্য দাবি রমজান আলীর:
ফোনে যোগাযোগ করা হলে রমজান আলী মাস্টার জানান, তার বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যার ১২টি মামলা রয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার পাশে আছেন এবং তাকে সহযোগিতা করছেন। তিনি বলেন, “আমার সম্পত্তির ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খোঁজখবর নিলেও তারা আমার কিছুই করতে পারবে না। রূপসী পল্লী টাওয়ারের ভবনগুলো পার্টনারশিপে করা হয়েছে।”
নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে প্রমাণ করতে তিনি আরও দাবি করেন, তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায় বারোটি মসজিদ কমিটির সভাপতি তিনি। মসজিদ উন্নয়ন ও ডেমরা এলাকার কবরস্থানে উন্নয়ন কাজে মোটা অঙ্কের অর্থদান করেছেন বলেও জানান।

স্থানীয়দের ক্ষোভ:
এলাকার সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, রমজান আলী মাস্টার ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে সরকারি খাস জমি দখল এবং সাধারণ মানুষের জমি কম দামে রেজিস্ট্রি করে নিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা না নিলে এলাকায় আরও বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *